পুলিশ আমাদের লজ্জা থেকে বাঁচাক

সুইন্ডে উইদারহোল্ড। ছবি: সংগৃহীত
সুইন্ডে উইদারহোল্ড। ছবি: সংগৃহীত

কিছুদিন আগে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আলাপ হয় জার্মান নারী সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী সিবিলি হফটারের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছবি তুলতে। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতায় তাঁর মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করলেন। বললেন, অনেক সমস্যা সত্ত্বেও তোমরা যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছ, এটি কম কথা নয়। সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের এই অবদানের কথা মনে রাখবে। কাজ শেষে সিবিলি নিরাপদের দেশেও ফিরে গেছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত। পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

কিন্তু সুইন্ডে উইদারহোল্ড নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারেননি। যাওয়ার আগে তাঁর ক্যামেরা ও ল্যাপটপ ছিনতাই হয়ে যায়। ফলে নিঃস্ব অবস্থায় সুইন্ডেকে দেশে ফিরে যেতে হয়। গত পাঁচ মাসের শ্রম ও সাধনা এক নিমেষে শেষ।

এই জার্মান তরুণী গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফটোগ্রাফি শিখতে। ছবি তুলতে। দেশভ্রমণ তাঁর প্রধান শখ। শখের বশে তিনি পর্বতময় মহাসড়ক পাড়ি দিয়েছেন। মরুপথে সাইকেল চালিয়ে হাজার মাইল পার হয়েছেন। কোথাও বিপদ হয়নি। বিপদে পড়লেন এই বাংলাদেশে এসে। গত বৃহস্পতিবার ভোরবেলায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে ছিনতাইকারীরা তাঁর ল্যাপটপের ব্যাগটি টান মেরে নিয়ে যায়। সব হারিয়ে শুক্রবার ভোরে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা ছেড়েছেন সুইন্ডে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ‘গত জানুয়ারিতে ধানমন্ডির পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে ফটোগ্রাফি কোর্স করতে ঢাকায় আসেন সুইন্ডে। তিনি চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা শিল্প, সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ অনেক জায়গায় প্রচুর ছবি তুলেছিলেন। সেই ছবিগুলো বিভিন্ন বন্ধুর কম্পিউটারে জমা ছিল। বুধবার রাতে শংকর বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক বন্ধুর বাড়িতে অন্য বন্ধুসহ রাতে থেকে তিনি সব ছবি তাঁর হার্ডডিস্কে স্থানান্তর করেন। ভোরবেলা এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের অস্থায়ী আবাসে ফিরতে তিনি একটি রিকশা ভাড়া করেন। রিকশাটি জিগাতলা পার হয়ে সীমান্ত স্কয়ারের ফটকে আসামাত্র একটি সাদা গাড়ি থেকে তাঁর ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে যায়। গাড়ির নম্বরপ্লেট বাংলায় থাকায় তিনি সেটি বুঝতে পারেননি। রিকশাচালকও সেটি খেয়াল করেননি। এ ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন সুইন্ডে। তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর দুটি হার্ডডিস্ক। দীর্ঘ সময় কষ্ট করে তোলা ছবি এতে রয়েছে। এ দুটি হার্ডডিস্কের জন্য বৃহস্পতিবার সারা দিনই কেঁদেছেন এই নারী। তাঁকে কিছু খাওয়ানোও যায়নি। শুক্রবার ভোরবেলা বন্ধুরা তাঁকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে আসেন।’

সুইন্ডে বাংলাদেশে প্রায় ছয় মাস ছিলেন। সতীর্থ ও শিক্ষকদের সঙ্গে আনন্দে কেটেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তের দুর্ঘটনায় তিনি মুষড়ে পড়েছেন। ছয় মাস ধরে যে কাজ করেছেন, তা দুর্বৃত্তরা ছিনতাই করে নিয়েছে। ঢাকা শহরে সকালের এই গাড়ি ছিনতাই পার্টির উৎপাত খুব বেড়েছে। কয়েক মাস আগে রিকশায় সদরঘাট থেকে আসা এক নারীর ব্যাগ ধরে ছিনতাইকারী টান দিলে তিনি গাড়ির নিচে পড়ে মারা যান। এ রকম কত মৃত্যু আর আহাজারির ঘটনা ঘটে ঢাকায়। আমরা কজন তার খোঁজ রাখি?

সুইন্ডে তাঁর ইনস্টাগ্রামে যা লিখেছেন, তা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার ও বেদনার। তাঁর অনুভূতি হলো, ‘একটি ঘটনা পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটি কালো মেঘে ঢেকে দিল। না, এটা (বাংলাদেশ) ভ্রমণের জন্য নিরাপদ নয়। একা ভ্রমণ না করাই ভালো।...আমি কেবল একটি কথাই বলতে পারি, দেখে-শুনে চলো, নিজের ক্ষেত্রে সাবধানে থেকো।...আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বাংলাদেশ ছাড়ছি।’

জার্মান তরুণী অপরিমেয় দুঃখ ও বেদনা নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছেন। আমরা তাঁর নিরাপত্তা দিতে পারিনি। সুইন্ডে বাংলাদেশে যে অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলেন, সেটি সারা জীবন তাঁর মনে ক্ষত হয়ে থাকবে। তিনি হয়তো আর কখনোই বাংলাদেশে আসবেন না। কিংবা তাঁর কাহিনি যাঁরা জানবেন, তাঁরাও বাংলাদেশকে অনিরাপদ ভাববেন।

তবে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি সুইন্ডের চুরি হয়ে যাওয়া ল্যাপটপটি উদ্ধার করতে পারেন, তাহলে মেয়েটির দুঃখের ভার কিছুটা কমবে। আমরা বলতে পারব, সুইন্ডে তুমি মন খারাপ কোরো না। আমরা তোমার প্রিয় ছবিগুলো উদ্ধার করেছি। তুমি বাংলাদেশকে অনিরাপদ ভেবো না।

ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ ইসলাম বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে। আমরা চেষ্টা করছি।’ শুক্রবার সকালে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটেছে। সোমবার যদি তাঁরা কোনো সূত্র বের না করতে পারেন, সেটি দুঃখজনক। যে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভয়ংকর জঙ্গিদের পাকড়াও করতে পারে, যারা মাটির নিচ থেকেও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারে, তারা ছিঁচকে ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে ল্যাপটপটি উদ্ধার করতে পারবে না, সে কথা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। তাদের তদন্ত দ্রুত শেষ হোক এবং সুইন্ডের ল্যাপটপটি উদ্ধার হোক।

আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটি উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে আমাদের লজ্জা আরও বাড়িয়ে দেবে। নানা কারণেই বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশে আসতে চান না। এ ধরনের অঘটন ঘটতে থাকলে তাঁদের সংখ্যা আরও কমে যাবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশর ‘উঁচু মাথা’ও নিচু হয়ে যাবে।