বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগে...

রাশিয়া বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আয়োজন। ছবি: রয়টার্স
রাশিয়া বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আয়োজন। ছবি: রয়টার্স

ইতালিতে তখন ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির শাসনামল। ইতালি ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক। ফাইনালের আগের দিন মুসোলিনির হুংকার, চেকস্লোভাকিয়া পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেললে আমরাও পরিচ্ছন্ন থাকব। আর যদি ওরা বাজে ফুটবল খেলে, আমরা তার থেকেও বাজে খেলব। শেষ পর্যন্ত ঘটনাবহুল ওই ফাইনালে ইতালি জিতে যায়। তখন সরাসরি সম্প্রচারের এতটা সুযোগ ছিল না। তাই অনেকেই খেলাটি দেখতে পারেননি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের থেকে খেলার ফলাফল জানতে হয়েছে বেশির ভাগ ইতালীয়কে। মুসোলিনির আমলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে সহজেই অনুধাবন করা যায়। ইতালির সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম বিশ্বকাপ জয়কে মুসোলিনির সরকারের বিশাল সাফল্য বলে প্রচারণা করে। গণমাধ্যম একধরনের প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনা ছড়িয়ে দেয় ইতালিজুড়ে। ১৯৭৮-এর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের কথাও বলা যায়। ওই সময় আর্জেন্টিনা সামরিক শাসকের অধীনে। নির্যাতন, আটক, বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কারণে সামরিক শাসকদের ভাবমূর্তির সংকট। বিশ্বকাপের আয়োজন ও জয় আর্জেন্টিনার সামরিক শাসককে ভাবমূর্তির পুনর্নির্মাণের সুযোগ করে দেয়।

বিশ্বকাপ ফুটবল বা বড় বড় ক্রীড়া আসর কি শুধুই নিখাদ খেলাধুলার আয়োজন বা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ; বরং খেলাধুলার বড় বড় আসরের আয়োজন ও পদক জয়ের সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতির এক গভীর সম্পর্ক আছে। কখনো কখনো খেলাধুলা জাতীয়তাবাদী প্রচারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বকাপ আয়োজনকে ইতালি ও আর্জেন্টিনার শাসকেরা নিজেদের ভাবমূর্তি পুনর্নির্মাণের সুযোগ হিসেবে নিয়েছিলেন।

রাশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনেও একই কারণ রয়েছে। রাশিয়াকে ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই লড়তে হচ্ছে। রাশিয়ার মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে আছে। বেকারের সংখ্যাও নেহাত কম না। সম্পদের অসম বণ্টন ক্রমেই বাড়ছে। আর দুর্নীতি লেগেই আছে সমাজের সর্বত্র। যদিও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা রাশিয়াকে খুব বেশি স্পর্শ করেনি। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যয় ও সম্পদের অপব্যবহারের অভিযোগ বরাবরই রয়েছে। যেমন বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করতে কয়েকবারই অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হয়েছে।

ঘরের বাইরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও রাশিয়াকে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছে। ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছেই। সাবেক গোয়েন্দাকে বিষপ্রয়োগ নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ইউক্রেন ও সিরিয়া সংকটে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া পুনরায় বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টায় আছে। আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার গোয়েন্দারা হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এমনকি ব্রেক্সিটেও ভূমিকা ছিল রাশিয়ার। রাশিয়ার গোয়েন্দারা ব্রেক্সিটের পক্ষে কাজ করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভেঙে দুর্বল করে দেওয়া। সিরিয়া যুদ্ধের পথ বদলে দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন থেকেও একরকম হতাশা নিয়েই ফিরেছে পশ্চিমা জোট। রাশিয়া পশ্চিমের বিকল্প হিসেবে চীনের সঙ্গে মিলে নতুন ক্ষমতার মেরু গঠনের চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ইরান, তুরস্ক ও ভারতকেও রাশিয়া পাশে পাচ্ছে কখনো কখনো। বিশ্বকাপের আয়োজন করে বিশ্বদরবারে নতুন এক রাশিয়াকে উপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন এ ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে চীনের অলিম্পিক আয়োজনকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন।

বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে রাশিয়া দুভাবে লাভবান হবে। সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট পুতিন লাভবান হতে পারেন। যদিও বিস্তর উদাহরণ আছে, বড় ধরনের ক্রীড়া আসরের পর শাসকদের ভরাডুবিও হয়েছে। পুতিন জুডোর ভক্ত। নিজেও জুডো খেলে থাকেন। কিন্তু দেশের ভেতরে ও বাইরে নিজের নতুন ভাবমূর্তি গঠনের জন্য পুতিন ফুটবলকেই বেছে নিয়েছেন ২০০৯ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রার্থিতা ঘোষণা করে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতার লড়াইয়ে স্পেন ও পর্তুগাল থাকলেও মূল লড়াইটা হয়েছে মূলত ব্রিটেনের সঙ্গে। প্রার্থিতার দৌড়ে রাশিয়া বিজয়ী হওয়ার পর ব্রিটেনের কর্তাব্যক্তিরা অভিযোগ করেছিলেন, রাশিয়া ফিফার কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছিল।

বিশৃঙ্খল অর্থনীতি, দুর্নীতি, পশ্চিমাদের অবরোধ, বিভিন্ন চাপকে সামলে নিয়ে পুতিন পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বকাপ আয়োজনকে পুতিন পশ্চিমাদের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবেই নিয়েছেন। এর আগেও শোচি শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে রাশিয়া বিরোধী পক্ষের চাপ ছিল। অ্যাথলেটদের ড্রাগ কেলেঙ্কারি নিয়েও রাশিয়া বিব্রতকর অবস্থায় ছিল।

আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়কে ছাপিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজন রাশিয়ার অর্থনীতিতে স্বল্প মেয়াদে নতুন গতির সঞ্চার করতে পারে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমন অর্থনীতিকে চাঙা করবে। আগামী বছর নাগাদ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি দেশজ উৎপাদন শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে। গত দুই বছরের প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি থেকে ঊর্ধ্বগতিতে ফিরে আসব অর্থনীতি। তবে একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির সংখ্যাও থেকে যায়। তবে সন্দেহ নেই বিশ্বকাপের আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার হোটেল, সেবা খাত, রেস্টুরেন্টগুলোর আয় বৃদ্ধি পাবে। এসব সেক্টরে স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সব মিলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে স্বল্প মেয়াদে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বিশ্বকাপ। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। বিশ্বকাপ-২০১০ উপলক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার যোগাযোগ খাতের আধুনিকায়ন করা হয়েছিল। এর সুফল এখনো দক্ষিণ আফ্রিকা ভোগ করছে।

নেহাত খেলাধুলার আয়োজন হলেও বিশ্বকাপের আয়োজন করে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকার করবে রাশিয়া। স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে বহুমেরুকেন্দ্রিক যে বিশ্বব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নেওয়া রাশিয়ার সমকালীন পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য। সফলভাবে বিশ্বকাপের আয়োজন রাশিয়ার নতুন ভাবমূর্তি গঠনের সহায়তা করবে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাশিয়ার গণতন্ত্র নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ায় হস্তক্ষেপ, ইউরোপের সঙ্গে টানাপোড়েনের পরপরই পুতিন যেন অনেকটাই স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন পশ্চিমা মিডিয়ায়। বিশ্বকাপ আয়োজন করে সারা বিশ্বের কাছে পুতিন রাশিয়ার সক্ষমতা নিয়ে নতুন এক বার্তা দিয়েছেন। জনসাধারণও তুষ্ট হতে পারেন পুতিনের ওপর।

অনেকেই বলে থাকেন, খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি ঠিক নয়। খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতি গভীরভাবে জড়িত। অলিম্পিকের আয়োজনই করা হয় এক রাজনৈতিক যুদ্ধের ঘটনাকে স্মরণ করেন। সংস্কৃতি, খেলাধুলায় জাতীয়তাবাদ প্রতিফলিত হয়। আবার জাতীয়তাবাদ প্রসারে খেলাধুলা কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশে ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ে। কারণ, এসব দেশ বিশ্ব ফুটবলের বড় শক্তি। বাংলাদেশে কিন্তু ইকুয়েডর বা পেরুর পতাকা ওড়ে না। ব্রাজিল বা জার্মানির পতাকাকে বাংলাদেশ অবধি নিয়ে এসেছে ফুটবল। জাতীয়তাবাদের অন্যতম বড় নমুনা হচ্ছে জাতীয় পতাকা।

বিশ্বকাপ জয় বা আয়োজনের মধ্যেই রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের বিষয় আছে। বিশ্বকাপ জয়কে মুসোলিনি বা আর্জেন্টিনার সামরিক শাসকেরা ভাবমূর্তি গঠনে ব্যবহার করেছিলেন বা বর্ণবাদোত্তর যুগে বিশ্বকাপের আয়োজন করে দক্ষিণ আফ্রিকা সামর্থ্যের জানান দিয়েছিল। এবারের বিশ্বকাপও রাশিয়া ও পুতিনের নতুন ভাবমূর্তি গঠনে বিশেষভাবে সহায়তা করবে। বিশ্বরাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও দেশটি রাশিয়া বলেই এমন করে ভাবতে হচ্ছে। খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতির সংযোগও খুব সহজভাবেই অনুধাবন করা যাচ্ছে।


ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি