জেনেভায় বিবৃতি

জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের অধিকার সংকোচন এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ-সম্পর্কিত উদ্বেগ নিরসনে অধিকতর উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার প্রতি বাংলাদেশের নীরবতা কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে কিছু বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে সোচ্চার এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিষয়টি উঠেছে। রাষ্ট্র হিসেবে এবং আমরা বাংলাদেশি গণমাধ্যম হিসেবে এই মুহূর্তে মিয়ানমার যাতে আরাকানে জাতিসংঘের স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারের অবাধ প্রবেশাধিকারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা দেয়, সেই দাবিতে সোচ্চার আছি। এবং আমাদের সেটা থাকতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা জানি, এ রকম একটি পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায় না। কিন্তু প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে দীর্ঘ মেয়াদে রাখার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এর সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

 সুতরাং, এ রকম একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে মানতে হবে, তার নিজের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকারের প্রশ্নটি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অভিযোগকারীর নিজের রেকর্ড অভিযুক্তের চেয়ে যত বেশি উন্নত হবে, ফরিয়াদির অবস্থানকে তা ততটাই শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশকে এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এখন নিজের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও মানবাধিকারের রেকর্ড নিয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন বারবার অঙ্গুলি নির্দেশ করছে, তখন সেই অর্জন অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়।

গত সোমবার জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের ৩৮তম অধিবেশনের শুরুতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার হিসেবে বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদনে তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের ক্ষেত্রে মানবাধিকারবিষয়ক সব প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে ব্যাপক ও প্রশংসনীয় সহযোগিতা দিয়েছে। এরপরই তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাখ্যাহীন নির্লিপ্ততায় উষ্মা প্রকাশ করেন। তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশের নিজের মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য মানবাধিকার পরিষদের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত র‍্যাপোর্টিয়ারদের ১০টির বেশি সফরের অনুমতির অনুরোধ বাংলাদেশ ফেলে রেখেছে। এ ধরনের অবস্থান খুবই হতাশাজনক।

লক্ষণীয়, গত পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বের ৪০টি দেশ জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের দেশে স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারদের ঢুকতে দেয়নি। তবে এর মধ্যে ১৫টি দেশ পাঁচটির বেশি অনুরোধ ঝুলিয়ে রেখেছে। এসব দেশের তালিকায় কোনো উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশ নেই। আছে কঙ্গো, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, জিম্বাবুয়ে ও পাকিস্তানের মতো দেশ। আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নিশ্চয় এসব দেশ থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু মানবাধিকার–সংক্রান্ত স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারদের প্রবেশের অনুমতি ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশও এসব দেশের সঙ্গে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার হাইনার বিলেনফেল্ড ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁর প্রতিবেদন বাংলাদেশকে আশ্বস্তই করেছে। আমরা আশা করব, মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ারদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দিতে ভয় পায় এমন দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসবে। সামনে বাংলাদেশে নির্বাচন। জাতিসংঘের র‍্যাপোর্টিয়ারদের প্রবেশের অনুমতি নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা বৃদ্ধি ও দেশটির ভাবমূর্তি উন্নত হবে।