গাজীপুর খুলনা হবে না কুমিল্লা?

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, হাসান উদ্দিন সরকার
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, হাসান উদ্দিন সরকার

জনগণ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে স্থানীয় সরকার সংস্থার একটি নির্বাচন হিসেবে নিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এটি নিয়েছে মর্যাদার লড়াই হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, খুলনার কৌশল কাজে লাগাতে পারলে গাজীপুরে জয় ছিনিয়ে নেওয়াও কঠিন হবে না। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপির নেতারা গাজীপুরে নিজেদের জয় ধরে রাখার ব্যাপারে আশাবাদী। তাঁদের দাবি, খুলনায় দলের মধ্যে যে মতভেদ ছিল, গাজীপুরে সেটি নেই। বরং এখানে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগটিই কাজে লাগাবে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ যদি জোর করে জয়ী হতে চায়, তাহলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জোরালো হবে।

আকারে গাজীপুর দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয়। মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। ওয়ার্ড ৫৭টি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হলেও গাজীপুরবাসী ২৬ জুন কাকে মেয়র হিসেবে বেছে নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করা। মনে রাখতে হবে ভোটের লড়াইয়ে যে-ই জয়ী হন না কেন, নির্বাচনটি যেন হেরে না যায়। মানুষ যেন ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে না ফেলে।

এমন সময়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে, যখন দেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জোর আলোচনা-বিতর্ক চলছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী ৩০ জুলাই আরও তিন সিটি করপোরেশন বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীতে নির্বাচন হবে। তাই গাজীপুরকে যদি প্রি-টেস্ট বা প্রাক্-বাছাই পরীক্ষা বলি, ওই তিন সিটির নির্বাচন টেস্ট হিসেবে গণ্য হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রি-টেস্ট ও টেস্টে জয়ী না হলে জাতীয় নির্বাচনের অগ্নিপরীক্ষায় তাদের অবতীর্ণ হওয়া কঠিন হবে। আমাদের দেশে নির্বাচন না করতে পেরে সিইসির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে।

এই প্রেক্ষাপটে বুধবার গাজীপুরে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের একযোগে মতবিনিময় সভায় যোগদান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। খুলনায় দেখেছি, কমিশনার মাহবুব তালুকদার মতবিনিময় করে আসার পর সিইসি কে এম নুরুল হুদা গিয়েছেন। দুজনের আলাদা যাওয়া এবং একসঙ্গে যাওয়ার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। ইসির সব সদস্য সম্মিলিতভাবে কোনো কথা বললে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা রাজনৈতিক দল বেশি গুরুত্ব দেবে। ‘আমাদের লোক’ ও ‘তাঁদের লোক’ বলে বিভাজন করবে না। বুধবারের মতবিনিময়ে সিইসি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটি তাঁর মনের কথা হলে সাধুবাদ জানাব।

গাজীপুরের বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, নির্বাচনী পর্যবেক্ষকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, গতকাল পর্যন্ত সেখানে নির্বাচনের পরিবেশ মোটামুটি ভালো। এটি আশার কথা। প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে কোনো সংঘাত-সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী হাসান সরকার নিজের দলের গুণকীর্তনের পাশাপাশি অন্য পক্ষের বদনাম করছেন। তবে সেটি বাগ্যুদ্ধের মধ্যেই সীমিত রয়েছে।

প্রথম দফা তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগ্রাসী ভূমিকা, বিশেষ করে বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল মামুনকে যেভাবে তারা নাজেহাল করেছিল, জনগণের মধ্যে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে সময় বিএনপিকে নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগও ছিল। ঈদের পর দ্বিতীয় দফা প্রচারকাজে সে রকম কিছু ঘটনা ঘটেনি। এর পেছনে ইসির শক্ত ভূমিকা থাকুক কিংবা পুলিশ সুপার হারুন উর রশীদ নিজেই এক কদম পিছিয়ে আসুন, গাজীপুরবাসী সুড়ঙ্গের শেষে কিছুটা হলেও আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে। ভোট গ্রহণ পর্যন্ত এই পরিবেশ বজায় থাকলে এবং গতকাল মতবিনিময় অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে ইসির পদাধিকারীরা যেসব অভিযোগ ও পরামর্শ পেয়েছেন, সেগুলো আমলে নিলে গাজীপুরে মোটামুটি সুষ্ঠু ভোট হওয়া অসম্ভব নয়।

আমরা আশা করতে পারি, নির্বাচন কমিশন খুলনায় যে ভুল করেছে, গাজীপুরে তার পুনরাবৃত্তি হবে না। তখন সিইসি স্বীকার করেছিলেন, খুলনায় কয়েকটি কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে। কিন্তু তিনি যে স্বীকার করেননি, নির্বাচনী প্রচারকাজ শুরুর পর থেকে সেখানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের দৌড়ের ওপর রেখেছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। করলে হয়তো খুলনাবাসী অপেক্ষাকৃত ভালো নির্বাচন পেত। তালিকাভুক্ত আসামিদের ধরতে নির্দিষ্ট বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালাতে পারে কিন্তু বেছে বেছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করার উদ্দেশ্য যে নির্বাচন, সেটি বুঝতে রাজনীতির পণ্ডিত হতে হয় না।

আওয়ামী লীগ নেতারা গাজীপুরকে তাঁদের শক্ত ঘাঁটি এবং ২০১৩-এর হারকে ‘হেফাজত প্রতিক্রিয়া’ বলে আত্মতৃপ্তির লাভের চেষ্টা করলেও সমস্যা যে দলের ভেতরেই, তা এখন ওপেন সিক্রেট। খুলনায় বিএনপির যেমন সাংগঠনিক সমস্যা ছিল, গাজীপুরে আওয়ামী লীগ একই সমস্যায় আছে। মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম প্রায় একক সিদ্ধান্তে ৫৬টি ওয়ার্ডে দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীরা সেই মনোনয়ন মানেননি বলে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান। এখন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই একে অন্যকে ‘বিএনপি-জামায়াতের লোক’ বলে গালাগাল করছেন।

পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে কেন্দ্রীয় নেতারাও সেখানে গিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেও সামাল দিতে পারেননি। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থী পদে কাউকে সমর্থন দেবেন না, শুধু মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন। নিজের চেষ্টায় যাঁরা কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন, তাঁদেরই দল গ্রহণ করবে। এই আপসকামী নীতি ভোটের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তার ওপরই নির্বাচনের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। আওয়ামী লীগ যে বরাবর নিজেদের সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল দল দাবি করে, গাজীপুরে তার কোনো ছাপ নেই। বরং বিএনপি ১২টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী না দিলেও বাকি সব ওয়ার্ডে একজন করে প্রার্থী দিতে পেরেছে। খুলনায় বিএনপির যে সাংগঠনিক ঘাটতি ছিল, সেই একই ঘাটতি গাজীপুরে আওয়ামী লীগ দেখাল।

গাজীপুরে এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কত নেতা আছেন? কেউ বলেছেন দুই দল থেকেই শতাধিক করে নেতা-কর্মী সেখানে নিয়োজিত আছেন। সিটি নির্বাচনের সময় খুলনা গিয়ে দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের আগমনে শহর ছিল সরগরম। তাঁরা সেখানে থেকে জনসংযোগ করেছেন। কিন্তু গাজীপুর ঢাকার কাছে হওয়ায় সেখানে কাউকে থাকতে হয় না। প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানা জানান, অন্তত প্রতি ওয়ার্ডে দুই দলেরই এক-দুজন করে কেন্দ্রীয় নেতা প্রচারকাজ চালাচ্ছেন। তাঁর কাছে জানতে চাই, এর মধ্যে কি সাংসদেরাও আছেন। তাঁর জবাব, ‘আছেন।’ কিন্তু নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী সাংসদেরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারকাজে অংশ নিতে পারেন না।

নির্বাচনে দুই প্রার্থী ইশতেহারে সব সমস্যার সমাধান এবং গাজীপুরকে আধুনিক সিটি করার লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটাররা এসব খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে তাঁরা জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্মহড়া হিসেবেই নেবেন এবং পছন্দসই দলকে ভোট দেবেন। তবে যাঁদের কাছে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কোনোটাই পছন্দের নয়, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম মন্দকে বেছে নেবেন। সেই কম মন্দের পাল্লা যেদিকে ভারী হবে, সেই দলই জয়ী হবে। গাজীপুরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ১১ লাখ ভোটারের মধ্যে ২ লাখই ‘বহিরাগত’ শ্রমিক। জয়-পরাজয়ে তাঁদের এবং তাঁরা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।

প্রশ্ন হলো গাজীপুর খুলনা হবে না কুমিল্লা? এখানে নির্বাচনের গুণাগুণ বিচার নয়, ফলাফল নিয়ে কথা বলছি। কুমিল্লায় জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থী আর খুলনায় আওয়ামী লীগ। গাজীপুরে কে জিতবেন সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে আরও চার দিন অপেক্ষা করতে হবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]