ইমরান কি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন?

ইমরান খান
ইমরান খান


গণতন্ত্রে হতাশা, নির্বাচনে উৎসাহ
পাকিস্তানে স্বাধীনতার সাত দশক পর গণতন্ত্রের নড়বড়ে চিত্র নিয়ে তীব্র হতাশা থাকলেও নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানিদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়। দেশটির ১৫তম ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে আগামী ২৫ জুলাই। ইতিমধ্যে নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি নাসির-উল-মুলকের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায়ী নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। বাংলাদেশ এ রকম নির্বাচনী মডেলের জন্মদাতা হলেও কার্যত এর সুন্দর বাস্তবায়ন করে দেখাচ্ছে পাকিস্তান। দেশটিতে এর আগের জাতীয় নির্বাচনও হয়েছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
নির্বাচনী রাজনীতিতে পাকিস্তান দ্বিদলীয় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তেজনার মধ্যেই দেশটির ৩ লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইলজুড়ে মুহূর্তে যে অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা চলছে, তাতে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিশ্চিত আভাস মিলছে। পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লিগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির সামনে নবীন দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নয়, অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ এবং ইমরান খান
পিটিআইয়ের জন্ম ১৯৯৬ সালে, ইমরান খানের হাত ধরে। তিনি পরের বছরই জাতীয় নির্বাচনে সাতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটিতে পরাজিত হন। ২০০২ সালের নির্বাচনে তাঁর দল মাত্র একটি আসনে জয়লাভ করে। তবে ধৈর্যশীল ফাস্ট বোলারের মতোই তিনি প্রথম দুটি নির্বাচনের হতাশাজনক ফলাফলে থেমে যাননি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল ৩১টি আসনে বিজয়ী হয়। তিনি নিজেও তিনটি আসনে জিতেছিলেন। তাঁর দল আসনের হিসাবে তৃতীয় স্থানে এবং ভোটের হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে।
এর পরই দলটির দারুণ এক নবজন্ম ঘটে। নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় ইমরান লাগাতার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের জন্ম দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিজেকে অন্যতম চালকের আসনে স্থাপন করেন। অনেকটা পিটিআইয়ের মেঠো চাপেই নওয়াজ প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান এবং আদালতের রায়ে তাঁকে দলের সভাপতির পদও ছাড়তে হয়েছে। প্রধান প্রতিপক্ষের এমন করুণ পরিণতিতে সরকার গঠন এবং প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনা হাতের মুঠোয় ধরে নিয়েই ইমরান খান ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন।
তবে বিতর্ক উঠেছে পিটিআইয়ের প্রতি পাকিস্তানের ক্ষমতাধর ‘গভীর রাষ্ট্রে’র (ডিপ স্টেট) সহানুভূতির ভবিষ্যৎ ফলাফল নিয়ে। রাজনীতিসচেতন পাঠকমাত্র জানেন, বিশ্বের অনেক দেশেই দৃশ্যমান ‘রাষ্ট্র’-এর ভেতরে কিছু সংস্থা—গোয়েন্দা বিভাগ, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি একক বা সম্মিলিতভাবে অদৃশ্য অবস্থান থেকে বেসামরিক সরকারের চেয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি অধিক নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এরাই ‘ডিপ স্টেট’ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত। দেশে দেশে এরূপ ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’-এর ধরন-সক্রিয়তা-তীব্রতায় ফারাক আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় করপোরেশন, এফবিআই, ইহুদি লবি বা সমরশিল্প খাত যেভাবে ডিপ স্টেটের ভূমিকা রাখে, কিংবা যুক্তরাজ্যে সিনিয়র সিভিল সার্ভিস সময়-সময় যে ভূমিকা নেয়; ভারতে অনুরূপ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট আরএসএস নেতৃত্ব। অতীতে রুশ দেশে একই ধরনের কার্যক্রমে দেখা যেত গোপন পুলিশি সংস্থা ‘কেজিবি’কে। তবে বিশ্বে বরাবরই পাকিস্তানের ডিপ স্টেট বেশ ‘স্বনামধন্য’। জন্মের পর থেকে দেশটিতে পাকিস্তানে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র রাজনীতির ওপর খবরদারি করে চলেছে প্রকাশ্য ও গোপনে; কখনো কখনো সহিংসভাবেও।
পাকিস্তানের বিগত মুসলিম লিগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরিফের পতনও সেখানকার ডিপ স্টেটের সঙ্গে সংঘাতের ফল বলেই দেশটির রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের ধারণা। এ ধারণার অর্থ এই নয় যে নওয়াজ ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর ও অভিযোগগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করে, শুধু দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ পরিবার একের পর এক ‘আদালতের রায়ে’ রাজনৈতিকভাবে এভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। সেখানে এ-ও অনুমান করা হয়, নওয়াজের বিরুদ্ধে অন্ধ বিরোধিতায় ইমরানকে ঠেলে দিয়েছে দেশটির শক্তিধর সেনা আমলাতন্ত্র।
এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্রের নতুন একটা সফলতার দিক হলো, তারা নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দে দেশটির বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকেও পাশে পাচ্ছে। নওয়াজ পরিবারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগের এমন জোটবদ্ধ অভিযানে রাজনীতিবিদ হিসেবে ইমরান খানের উদ্দীপ্ত না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে অনেক সময়ই প্রতিপক্ষকে যেকোনো উপায়ে হটিয়ে ক্ষমতা পাওয়ার প্রশ্নটিই মুখ্য হয়ে ওঠে।

‘নয়া পাকিস্তান’ গড়তে চান ইমরান
পাকিস্তানের জন্য একটা বড় সফলতা এই যে দেশটি গত ১০ বছরে দুটি পার্লামেন্ট নির্বিঘ্নে মেয়াদ শেষ করতে পারল। ইমরানের উত্থান দেশটির পার্লামেন্টারি রাজনীতির এই সুসময়ে। কিন্তু এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর কতটা আস্থা আছে, তা একটা প্রশ্ন।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, পাকিস্তান সদ্য সমাপ্ত ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির ৪৬৮টি কর্মদিবসে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়েও ইমরান খান উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১৮ দিন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েও গত পাঁচ বছর প্রায় পুরো সময় তিনি কর্মক্ষেত্র হিসেবে রাজপথকেই বেছে নিয়েছিলেন। অথচ পাকিস্তানে ডিপ স্টেটের বিপরীতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ়তার জন্য পার্লামেন্টে সব সদস্যের সক্রিয় উপস্থিতি জরুরি।
এখন আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে ইমরান ইশতেহারে বলছেন, তিনি এক ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়তে ইচ্ছুক। ক্ষমতা পেলে প্রথম ১০০ দিন কী কী কাজ করবেন, তারও একটা ফর্দ তিনি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বিপুল। যিনি তাঁদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন, তিনি সুশাসনও আনতে পারবেন, এমনটিই তাঁরা বিশ্বাস করেন।
কিন্তু নির্বাচনী জরিপগুলো বলছে, আদালতের রায়ে নওয়াজ প্রধানমন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ ছাড়তে বাধ্য হলেও মুসলিম লিগের জনপ্রিয়তা খুব বেশি কমেনি, বিশেষত পাঞ্জাবে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাঞ্জাব এখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে রয়েছে ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির ১৪১টি আসন (মোট আসনের অর্ধেকের বেশি) এবং এসব আসনের ভাগীদারেরা নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত ৭০ আসনেরও বড় হিস্যা পাবে। সর্বশেষ জরিপগুলো বলছে, আদালতের রায়ে মূল নেতৃত্ব বিপর্যস্ত হলেও মুসলিম লিগ পাঞ্জাবে পিটিআইয়ের চেয়ে গড়ে অন্তত ১০ শতাংশ বেশি সমর্থনে এগিয়ে রয়েছে। আহত হলেও বাঘ (মুসলিম লিগের নির্বাচনী প্রতীক) যেন হাল ছেড়ে দিতে নারাজ। পাঞ্জাবে গত এক বছরে যেসব উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে মুসলিম লিগের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে, এমন লক্ষণ নেই। অনেকেই বলছেন, এটা হলো নওয়াজ বনাম ডিপ স্টেট দ্বন্দ্বে প্রথমোক্ত জনের প্রতি সহানুভূতির ভোট।
ভুট্টোদের পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সিন্ধুতে শহরাঞ্চলে শক্তি হারালেও গ্রামীণ এলাকায় পিটিআইয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে। পাঞ্জাব আর সিন্ধু মিলে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির ৭৪ শতাংশ আসন নিয়ন্ত্রণ করে মুসলিম লিগ ও পিপিপি। ফলে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে মুসলিম লিগ ও পিপিপিকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা ছাড়া ইমরানের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া কঠিন।

গতবারের চেয়ে ১৩৫ আসন বেশি পেতে হবে
এসব জরিপ ছাড়াও ইমরানের জন্য আরও একটা বাজে শঙ্কা রয়েছে। যদি পিটিআই সামগ্রিকভাবে নির্বাচনে প্রথম স্থান পায়, কিন্তু ১৭২ আসনের চেয়ে পিছিয়ে থাকে, তাহলে ইমরানকে ঠেকাতে নওয়াজ ও ভুট্টো পরিবার জোট করে ফেলতে পারে, কিংবা নওয়াজের দল পিপিপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিতে পারে। এ রকম সব শঙ্কা দূর করতে হলে ইমরানকে গত নির্বাচনে পাওয়া ৩৫টি আসনের চেয়ে এবার অন্তত আরও ১৩৫টি আসন বেশি পেতে হবে, যা দুরূহতম এক চ্যালেঞ্জ বটে। কোনো জরিপ এখনো তেমন ইঙ্গিত দিতে পারছে না। তবে ইমরানের প্রতি ভোটারদের পক্ষপাত ক্রমে বাড়ছে এবং বিশ্বজুড়ে জরিপকে চমকে দেওয়া নির্বাচনী ফলাফলও বহু দেখা গেছে। সেই সম্ভাবনার কারণেই হয়তো বিভিন্ন দল থেকে অনেক রাজনীতিবিদ প্রায় দিনই পিটিআইয়ে যোগ দিচ্ছেন। তাঁরা জানেন, ক্রিকেট ক্যাপ্টেন এবং দলের মূল পেসার হিসেবে খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান বহু কঠিন ম্যাচের মোড় ঘুরিয়েছেন।
বলা বাহুল্য, নির্বাচনী রাজনীতি ক্রিকেট ম্যাচের চেয়ে বেশি কিছু। তবে দুরূহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইমরানের খেলোয়াড়ি অভিজ্ঞতা হয়তো তাঁকে পথ দেখাবে। কিন্তু তাতে পাকিস্তানে ‘ডিপ স্টেটের’ বিপরীতে গণতন্ত্র কতটা সবল হবে, সে বিষয়ে উদ্বেগ থেকেই যায়।

আলতাফ পারভেজ সাংবাদিক, গবেষক