কাশ্মীরে বিজেপির নতুন মারপ্যাঁচ

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজানাথ সিংয়ের সঙ্গে কাশ্মীরের সদ্য পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। ছবি: এএফপি
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজানাথ সিংয়ের সঙ্গে কাশ্মীরের সদ্য পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। ছবি: এএফপি

১৯৭৭ সালের পর এই নিয়ে আটবার আর বর্তমান রাজ্যপালের হাত দিয়ে মোট চারবার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হলো কাশ্মীরে। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রপতির পক্ষে সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপাল এন এন ওয়ারা এখন ভূস্বর্গের একক অধিপতি। কেন্দ্রীয় শাসন জারির সংবাদে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন কাশ্মীরের পুলিশপ্রধান এস পি বৈদ্য। বলেছেন, ‘এবার আমাদের কাজ অনেক সহজ হবে।’ তাঁর দাবি, ‘রাজ্যপালের শাসনে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।’ আমলারা আগাপাছতলা আমলাদের শাসন চাইবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই; তবে প্রকাশ্যে এমন উচ্চারণ খুব স্বাভাবিক নয়। তাহলে কি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের লাইন বুঝেই এস পি বৈদ্য হাই তুলছেন? ১৯ জুন বেলা ১১টা নাগাদ বিজেপিপ্রধান অমিত শাহের সঙ্গে অজিতের সলাপরামর্শ শেষ হওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বিজেপি নেতা রাম মাধব জানিয়েছিলেন, কাশ্মীরে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে পড়ায় সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়া ছাড়া রাস্তা নেই। বিজেপির এই রথ উল্টে দেওয়ার খবর মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি পান রাজ্যপালের টেলিফোনে। অমিত শাহ বা মোদি না হোক, অন্তত কাশ্মীরের রাজ্য বিজেপি সভাপতি রবীন্দ্র রাইনা মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবার সঙ্গে দেখা করে জোট ভাঙার কথাটা বুঝিয়ে বললে মেহবুবার হায়-আফসোস হয়তো একটু কম হতো। যদিও তিনি তাঁর দিলের কষ্টটা চাদরে ঢেকে দেরি না করে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগ করেছেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করায়, অর্থাৎ ৮৭ আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৪৪টিতে জিততে না পারায় জোট গঠন ছাড়া ক্ষমতার মসনদে আরোহণের কোনো পথ খোলা ছিল না। মেহবুবা মুফতির পিডিপি বিজেপির থেকে মাত্র তিনটা আসন বেশি পেয়ে (মোট ২৮) একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও সরকার গঠনের জন্য অন্যদের সমর্থন দরকার ছিল। কংগ্রেস (১২ আসন) আর ফারুক আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্সের (১৫ আসন) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারতেন মেহবুবা। কিন্তু তিনি বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধাকেই বেশি নিরাপদ আর টেকসই মনে করেছিলেন। দুটি আসন নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্সও যোগ দেয় সেই জোটে। রাজনীতি আর প্রেমে নাকি সবই বৈধ কাজেই সেক্যুলার পিডিপির সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক বিজেপির এক পেয়ালায় চা বা রক্ত কোনোটাই পানে বাধা নেই। তবে চা বা রক্ত কোনোটাই মেহবুবা মুফতির দল স্বস্তিতে পান করতে পারছিল না।

এরই মধ্যে ঘটল কাশ্মীরিদের আস্থাভাজন পত্রিকার সম্পাদক সুজাত বুখারি হত্যার ঘটনা। এর আগে প্রতিবাদ মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা যুবককে খোলা জিপের সঙ্গে বেঁধে বন্দুক উঁচিয়ে সেই জিপ নিয়ে টহল দেওয়ার নির্মমতা মেহবুবাকে সহ্য করতে হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সেই বেরহম কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা দূরে থাক, দিল্লি তাকে শাবাশি দিয়েছে। তারপর ঘটে আট বছরের আসিফা বানুকে এক মন্দিরের পূজারি দ্বারা অপহরণ, ধর্ষণ, খুন আর গুমের ঘটনা। গরিব আসিফাকে সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল; জানুয়ারির সেই ঘটনা আবার কাশ্মীরকে উত্তাল করে তোলে এপ্রিলে যখন মেহবুবার মন্ত্রিসভার দুজন বিজেপি সদস্য আসামিদের পক্ষে মিছিলে অংশ নেন। সে যাত্রায় জোট বাঁচাতে ওই দুই মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার আবদার বিজেবি কবুল করে। মেহবুবা কাশ্মীরের রাজনীতিতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (আসলে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকামী) বিরুদ্ধে রমজান মাসে একতরফা যুদ্ধবিরতিতে কেন্দ্রকে রাজি করান। এতে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা খুশি ছিলেন না।

মেহবুবার পতনের পর নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান এ পি বৈদ্য কোনো রকম রাখঢাক না করে জানিয়ে দিয়েছেন, রমজান মাসে জম্মু-কাশ্মীরের সংঘর্ষবিরতিতে জঙ্গিদেরই সুবিধা হয়েছে। সংঘর্ষবিরতির সময় শুধু হামলার মুখে পড়লেই নিরাপত্তা বাহিনী পাল্টা হামলায় যেতে পারবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গিরা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, সে ব্যাপারে তথ্য মিলছিল না। ফলে বিরতি জঙ্গিদের সুবিধা করে দিয়েছে।

মেহবুবা চেয়েছিলেন বিরতি ঈদের পরেও বহাল থাকুক। মোদি সরকার সেটা চায়নি। শেষ পর্যন্ত এই টানাপোড়েনেই জোট ছুটল। জোট ভাঙার কারণ ব্যাখ্যা করে বিজেপি বলছে, তারা না ছাড়লে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মেহবুবাই ছেড়ে যেতেন। আসলে অস্বস্তির এই জোটের মারপ্যাঁচে দুপক্ষই ক্রমে তাদের ভোটব্যাংক হারাচ্ছিল। বিজেপি হারাচ্ছিল জম্মু-লাদাখে আর মেহবুবা কাশ্মীরে। ভোটব্যাংক ফিরে পেতেই দুই পক্ষেরই জোট ছাড়া প্রায় ফরজ হয়ে পড়েছিল।

জোট ভেঙে বিজেপি এখন দেশভক্তি আর জাতীয়তাবাদের তাস নিয়ে নতুন খেলা সাজাবে। শ্রীনগর থেকে ত্রিবান্দ্রাম পর্যন্ত এখন তারা পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরব শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার মওকা পাবে। আর মেহবুবা নিজেকে শান্তি আর আলোচনার পক্ষের শক্তি হিসেবে তুলে ধরার ফুরসত পাবেন। ইতিমধ্যেই তিনি পেশিশক্তি নয়, বরং মানবিক স্পর্শ দিয়ে দিল জয়ের কথা বলতে শুরু করেছেন। তড়িঘড়ি করে জোট ভাঙার আরেকটা কারণ, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের আসন্ন অমরনাথ যাত্রা। ২৮ জুন থেকে শুরু হওয়া অমরনাথযাত্রা নির্বিঘ্নে পার করাটা বিজেপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাই হয়তো সেনাদের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ ছিল না। জম্মু-কাশ্মীরের সংযুক্ত কমান্ডের দায়িত্ব ১৮ জুন পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবার হাতে থাকলেও এখন তা চলে গেছে রাজ্যপাল এম এন ওয়ারার কাছে—মানে কেন্দ্রের হাতে। ক্যালেন্ডারের হিসাবে রাজ্যপালের মেয়াদ জুনেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন শোনা যাচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ রাজ্যপালকে কমপক্ষে তীর্থযাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেখে দেওয়া হবে।

নিরাপদ অমরনাথযাত্রা বা ভোটব্যাংক সুরক্ষা ছাড়াও বিজেপি অন্য আরেক মতলব মাথায় রেখে এবারের তাস চেলেছে। বিজেপি ফিরতে চাইছে তাদের ৩৭০ ধারার রাজনীতিতে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাসংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার দাবি বিজেপির মূল দাবি। রামমন্দির বা তিন তালাক ইস্যু এখন আর তেমন ঢেউ তুলতে পারছে না। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে মেরুকরণের রাজনীতিতে ৩৭০ ধারা একটা বড় হাতিয়ার হতে পারে। জনসংঘের আমল থেকেই সংঘ পরিবারের নেতারা সংবিধানের ৩৭০ ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার দেওয়ার বিরুদ্ধে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাম মাধব আবার বলতে শুরু করেছেন, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি বিজেপির প্রধান কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়ে সংসদই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বিজেপি এ বিষয়ে আদালতকেও টেনে আনার চেষ্টা করছে, ইতিমধ্যে সংবিধানের ৩৫ ধারার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের হয়েছে। এই ধারায় ১৯৫৬ সালে গৃহীত জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে শুনানির দাবি তুলেছে। গরমের ছুটির পরে আগস্টে এই মামলার শুনানি। আদালত সাজানোরও কাজ এগিয়ে চলেছে।

কাশ্মীরিদের আশঙ্কা, এই শুনানিকে কেন্দ্র করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় তুলবে বিজেপি। সে ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি নিয়েও বিতর্ক শুরু হবে। আসন্ন লোকসভার নির্বাচনে হিন্দি বলয়কে (উত্তর ভারত) সাম্প্রদায়িকতায় মাতিয়ে ৩৭০ আর ৩৫ ধারার বিরুদ্ধে জিগির তোলাই পক্ষে টানার মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে। কাশ্মীরের মানুষের মতের বিপক্ষে গিয়েও যদি দিল্লির মসনদ রক্ষার ভোট জেতা যায়, তাহলে ক্ষতি কী?

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।