বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ আবার নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির ক্রমাগত এগিয়ে চলার যে ধারা, তার সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের অবস্থাটা যেন ঠিক মিলছে না। কয়েক বছর ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ওপরের দিকে গেলেও তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এখনো যথেষ্ট আকর্ষণ তৈরি করতে পারেনি বলে মনে হয়। বিদেশি বিনিয়োগ এখনো জিডিপির ২ শতাংশেই উন্নীত হতে পারেনি।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০১৮ প্রকাশ করেছে। তা থেকে দেখা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ তার আগের বছরের তুলনায় কমেছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৬ সালে যেখানে দেশে ২৩৩ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, ২০১৭ সালে তা কমে হয়েছে প্রায় ২১৬ কোটি ডলার। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় (এলডিসি) বিদেশি বিনিয়োগ টানার শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

আঙ্কটাড প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, গত বছর মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৩০ কোটি ডলার, যা এলডিসিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর যথাক্রমে ইথিওপিয়া, কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক ও বাংলাদেশের অবস্থান। অবশ্য এই পাঁচ দেশের মধ্যে মিয়ানমার ও কম্বোডিয়াতেই বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বাকি তিন দেশেই কমেছে। আবার এই পাঁচ দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ শুধু আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের চেয়ে এগিয়ে আছে। ২০১৩-১৮ সময়ের বা গত পাঁচ বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার থেকে এটা স্পষ্ট হয়। এই সময়ে মোজাম্বিকের গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ আর বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আলোচ্য পাঁচ বছরে মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশের ওপরে আর ইথিওপিয়ার ৮ শতাংশের ওপরে।

আসলে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে ধারা, তা হলো সাম্প্রতিক অর্জন। ২০১৬ সালে (২০১৫-১৬ অর্থবছরে) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রথমবারের মতো ৭ শতাংশ হার অতিক্রম করে। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। অন্যভাবে বললে, কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এখনো যথেষ্ট টেকসই হয়নি। আর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের একটা ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতি কতটা গতিশীল এবং সে দেশে ভোক্তাশ্রেণি কীভাবে বড় হচ্ছে, তা বোঝার জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি উন্নয়নশীল কোনো অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও নির্দেশ করে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বেশি এলে একটি পর্যায়ে তা আবার প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতেও ভূমিকা রাখে।

এটা ঠিক যে গত বছর বিশ্বব্যাপী মোট প্রত্যক্ষÿবিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহে ধস নেমেছিল। ২০১৬ সালের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমে বিশ্বজুড়ে মোট বিদেশি বিনিয়োগ ২০১৭ সালে নেমে এসেছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি ডলারে। দলগতভাবে এলডিসিতে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৭ শতাংশ। সে বিবেচনায় হয়তো স্বস্তি মেলে যে এককভাবে বাংলাদেশের জন্য বিদেশি বিনিয়োগে বিপর্যয় ঘটেনি। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে বেশির ভাগ দেশে কমলেও কিছু কিছু দেশে ঠিকই বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে।

বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ প্রাপ্তির প্রত্যাশা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা দলিল অনুসারে, ২০১৬-২০ সময়ে দেশে গড়ে প্রতিবছর অন্তত ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ টানার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বাস্তবে প্রথম প্রায় তিন বছরে (২ বছর ১০ মাস) গড়ে বছরে ১৫০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় (সারণি-২ দ্রষ্টব্য)।

বোঝাই যাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রাপ্তির যে প্রত্যাশা করা হয়েছে, বাস্তবতা তা থেকে অনেক দূরে। খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিনিয়োগ সহায়ক অবকাঠামো সৃজন, জ্বালানি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন, শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা প্রদান এবং বিধি-বিধান ও আইন-কানুন সহজীকরণ সত্ত্বেও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বেসরকারি বিনিয়োগের হার আশানুরূপ হারে না বাড়ার বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছি; প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছি।’ (পৃ-৬৯, বাজেট বক্তৃতা ২০১৮-১৯)

অর্থাৎ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এখনো যথেষ্ট সহায়ক বলে বিবেচিত হয়নি। এখনো দেশে ব্যবসার করার জন্য নানা ধরনের বাড়তি ব্যয় বহন করতে হয়। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা, জটিল কর কাঠামো, বন্দরে কালক্ষেপণ ইত্যাদি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতির বিচিত্র ছড়াছড়ি যেকোনো বিনিয়োগের ব্যয় বাড়িয়ে তুলতে বাধ্য। এসব কারণেই বিদেশি বিনিয়োগের বড় অংশই আসলে বিদ্যমান বা চলমান বিনিয়োগে থেকে অর্জিত আয় ও মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ রয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগের অর্ধেকই হলো পুনর্বিনিয়োগ। বাকি অর্ধেকটার এক-তৃতীয়াংশ হলো আন্তকোম্পানি ঋণ আর দুই-তৃতীয়াংশ হলো নতুন বা ইকুইটি বিনিয়োগ।

আবার বিদেশি বিনিয়োগ এলেই হলো না। এই বিনিয়োগের সঙ্গে কতটা প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান স্থানান্তরিত হলো, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কতটা টেকসই ও মানসম্মত কর্মসংস্থান হলো এবং কতটা স্থানীয় মূল্য সংযোজন সক্ষমতা বাড়ল। এর পাশাপাশি বিনিয়োগ গ্রহণকারী দেশের শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা বৈশ্বিক মূল্য নিগড়ে (গ্লোবাল ভ্যালু চেইন বা জিভিসি) সম্পৃক্ত হতে পারছে, সেটাও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জিভিসি বলতে একটি পণ্যের উৎপাদন তথা মূল্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে একাধিক দেশ যুক্ত থেকে পণ্যটির উৎপাদন সম্পন্ন করার পুরো ব্যবস্থাকে বোঝায়। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে জিভিসিতে সম্পৃক্ততা বাড়াতে সমর্থ হয়েছে। বর্তমানে জিভিসি অংশগ্রহণ হার অনুসারে ২৫টি শীর্ষ উন্নয়শীল রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। আর জিভিসি অংশগ্রহণের হার ৩১ শতাংশ। গুণগত মানের বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে এই হার আরও বাড়বে।

এদিকে এলডিসির কাতার থেকে বের হয়ে আসার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে এলডিসি তকমাটি আর থাকবে না। এই পথযাত্রায় সহজ শর্তে বিদেশি ঋণ ও বিদেশি সহায়তা কমে আসতে থাকবে। বিপরীতে ক্রমবর্ধমান অর্থায়ন চাহিদা মেটাতে বাণিজ্যিক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়তে পারে। কিন্তু ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক ঋণ যে বাড়তি দায় সৃষ্টি করবে, তা মেটাতে গিয়ে লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ বাড়তে পারে। এ রকম একটি অবস্থায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগই হতে পারে অর্থায়নের টেকসই উৎস। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এখন বিদেশি বিনিয়োগই বাইরের অর্থায়নের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এসব দেশের ৩৯ শতাংশ বাইরের অর্থায়ন আসে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে আর ২৪ শতাংশ রেমিট্যান্স থেকে। অন্যদিকে, এলডিসিগুলোয় সমন্বিতভাবে বিদেশি অর্থায়নের প্রধান উৎস বা ৩৬ শতাংশ এখনো আনুষ্ঠানিক বিদেশি সহায়তা। রেমিট্যান্স থেকে আসে ২৮ শতাংশ আর বিদেশি বিনিয়োগ থেকে ২১ শতাংশ। ক্রমাগত উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সত্ত্বেও এলডিসি থেকে উত্তরণের যাত্রায় গুণগত ও টেকসই বিদেশি বিনিয়োগ টানা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকছে।

সর্বোপরি বিদেশি বিনিয়োগের প্রতি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের একাংশের এখনো বেশ অনেকটা রক্ষণশীল ও নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এই মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গিও বিদেশি বিনিয়োগ আনার পক্ষে সহায়ক নয়।

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক
[email protected]