গড় আয়ু বেড়েছে

কিছু সুখবর আছে, যা নিঃশর্ত আনন্দের; যা কাঁধের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় না। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার কোনো সমর্থক যখন শোনেন তাঁর দল বিশ্বকাপ জিতেছে, তখন তিনি নির্মল আনন্দ উপভোগ করেন। উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া ছাড়া তাঁর কোনো দায়িত্ব বা কর্তব্য থাকে না। কিন্তু হতদরিদ্র একজন দিনমজুর যখন শোনেন তাঁর মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে তখন একদিকে তিনি আনন্দাশ্রুতে ভেসে যান, অন্যদিকে সেই আনন্দের ফাঁকে কপালে ফুটে ওঠে চিন্তার রেখা। মেয়েটাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা দরকার, সে কোথায় থাকবে, খরচপত্তর কোত্থেকে আসবে—এই চিন্তা তাঁকে ফুটবল-ভক্তের মতো নিঃশর্ত আনন্দ উপভোগ করতে দেয় না। 
ঠিক এ রকম একটি কর্তব্য-ঘনিষ্ঠ সুখবর দিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তারা বলেছে, বাংলাদেশিদের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ বছরে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগে যা ছিল ৭১ দশমিক ৬ বছর। এক বছরের ব্যবধানে গড় আয়ু বেড়েছে ৪ মাস ২৪ দিন। 
মানুষের আয়ু এমনি এমনি বাড়ে না। এর সঙ্গে সামগ্রিক জীবনমানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। দেশ থেকে কলেরা, গুটিবসন্ত নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ডায়রিয়ায় হাজারে হাজারে শিশু এখন আর ঢলে পড়ে না। দেশে এখন কাঁচা পায়খানা নেই বললেই চলে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। ভাতের সঙ্গে একটু আমিষ খাওয়ার সামর্থ্য এসেছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো সচেতনতা ও সামর্থ্য দুটোই বেড়েছে। সামগ্রিক জীবনমান বাড়ছে। এতগুলো সম্মিলিত সুখবরের মজবুত ভিত্তির ওপরই আয়ু বাড়ার সুখবর দাঁড়িয়ে আছে। 
দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়াকে সমৃদ্ধির লক্ষণ বলতেই হবে। কিন্তু বয়স বাড়াটাই তো সব নয়! গড় আয়ু বাড়ছে মানে দেশে প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এই প্রবীণেরা হচ্ছেন সেই নাগরিক, যাঁদের দীর্ঘদিনের সম্মিলিত অবদানের কারণে বিবিএস এই সুখবর দিতে পেরেছে। কিন্তু সেই প্রবীণদের জীবনসায়াহ্নের দিনগুলোকে আমরা কতটুকু মর্যাদাকর রাখার ব্যবস্থা করতে পেরেছি? অন্য খাতগুলোর তুলনায় সামাজিক সুরক্ষার দিকটির ওপর আমরা কি যথার্থ জোর দিতে পেরেছি?
সময়ের অমোঘ স্রোতে সমাজ থেকে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে পড়ছে। সন্তানেরা বড় হয়ে, সচ্ছল হয়ে আলাদা সংসার গড়ছে। বৃদ্ধ মা-বাবা দিনকে দিন অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। ঐতিহ্যগত কারণেই আমাদের প্রবীণেরা সচ্ছলতা থাক বা না থাক—সন্তান ও আপনজনের সান্নিধ্যে থাকতে চান। শেষ বয়সে নিজ সন্তানের সেবা আশা করেন। কিন্তু তাঁদের সেই আশা ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্ম প্রবীণদের সেই আবেগ উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। বৃদ্ধ মা-বাবাকে অবহেলা করা, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের খবরও সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে আসে। 
আশার কথা, সরকার ‘পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ চালু করেছে। এই আইনের আওতায় ভরণপোষণে ব্যর্থতার জন্য সন্তানের সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে, আর সেই অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে তিন মাস কারাভোগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আইন হলেও এর প্রচার কম হয়েছে। তাই আইনটির প্রয়োগও হচ্ছে কম।
শুধু আইন করে প্রবীণদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে না। তাঁদের সুরক্ষায় 
দরকার একটি সুস্থ জনমানস গড়ে তোলা। তার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, তা আমাদের নেই। এই প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। নইলে এই আয়ুবৃদ্ধি আর এই সভ্যতার সার্থকতা কোথায়? ‘ভরাট করা সমুদ্র আর উচ্ছেদ করা অরণ্যের জগতে কী লাভ গড়ে কৃমি-কীটের সভ্যতা, লালন করে স্তিমিত দীর্ঘ পরমায়ু কচ্ছপের মতো?’