গাজীপুরে ভয় মেশানো জয়

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ফল ঘোষণার পর িবজয়ী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ফল ঘোষণার পর িবজয়ী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল মান্নান পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লার বাক্সে জমা পড়েছিল ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৬৭৭। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, এবার আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন ৪ লাখ ১০ ভোট এবং বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট। ধানের শীষের চেয়ে নৌকা ২ লাখ ৩ হাজার বেশি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কী এমন ঘটনা ঘটল যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজয় কাটিয়ে বিশাল ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে নিলেন?
সরকারি দলের নেতাদের দাবি, সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার দেখেই মানুষ গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে। কিন্তু গাজীপুরে উন্নয়নের কোনো লক্ষণই দেখলাম না। উন্নয়নের কারণেই যদি আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিতবেন, রংপুর ও কুমিল্লায় তেমনটিা ঘটল না কেন?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি জিতলে বলে নির্বাচন ঠিক হয়েছে, আর হারলে বলে বেঠিক হয়েছে। কোনো দল এই মনোভাব পোষণ করলে আমরা জোরালো ভাষায় তার নিন্দা করব। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জয়ী হন, সেখানে নির্বাচনে কারচুপি, ব্যালট পেপারে জবরদস্তি সিল মারা কিংবা বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে কেন? তাঁরা নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়ের কথা বলতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগে আইভী একজনই। অতএব, নারায়ণগঞ্জরে উদাহরণ এখানে খাটে না।
আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে যতই অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ দাবি করুক না কেন, এর পেছনে যে ‘অভিনব’ কৌশল ছিল, সেটাই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্তে বেরিয়ে আসছে। ইসির অনুমোদনপ্রাপ্ত ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ গাজীপুরের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে বলেছে, ৮৬.৫ শতাংশ কেন্দ্রে ১৫৯টি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ফলাফল শিটে ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখা, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অননুমোদিত ব্যক্তিদের অবস্থান এবং কেন্দ্রের চার শ গজের মধ্যে প্রার্থীর পক্ষে প্রচার। গাজীপুরে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২৫টি। এর মধ্যে ৪৬.৫ শতাংশ অনিয়ম হলে কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯৭। তাহলে এই নির্বাচনকে কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচন বলা যায়? ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ কমিশনের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান বলেই ধারণা করি। কেননা এই গ্রুপে এমন প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের নির্বাচনী কাজের অভিজ্ঞতা নেই। আবার ফেমা ও ব্রতীর মতো সংগঠনকে বাদ দেওয়া হয়েছে নিছক কারিগরি ত্রুটির অজুহাতে।
খুলনার সঙ্গে তুলনা করলে গাজীপুরের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সহংিসতার ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। কিন্তু এই ‘শান্তির’ পেছনেও যে মস্ত বড় অশান্তি ছিল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম গতকাল মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, এক দিনে নির্বাচন হয় না। এর পেছনে থাকে দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার কোথাও ঘাটতি বা দুর্বলতা থাকলে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
শুরু থেকেই বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার তাঁদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানোর কথা বলে আসছিলেন। সর্বশেষ তিনি উচ্চ আদালতে এর বিরুদ্ধে মামলাও করেন। কিন্তু আদালতের আদেশ জারির আগেই বিএনপির বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এমনকি আদালতের নির্দেশের পরও দুজন বিএনপি কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। পুলিশের ভয়ে অনেক নেতা–কর্মী বাড়িতে থাকতে পারেননি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দল শতভাগ মাঠ সমতল পাবে, সেই ভরসা করি না। কিন্তু নির্বাচনী প্রচার ও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয় থাকতে পারে, সে রকম একটি ‘ভদ্রোচিত’ পরিবেশ থাকতে হবে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বই মুখ্য। কিন্তু খুলনা বা গাজীপুরে তারা সেটি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। মতবিনিময় সভায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যেসব আভিযোগ করেছেন, তার একটিও তারা আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। খুলনায় নির্বাচনের আগে পুলিশ ব্লক রেইড দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আটক করলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। কিন্তু গাজীপুরে যা ঘটেছে, তা খুলনার চেয়েও বিপজ্জনক। পুলিশ পরিচয় দিয়ে সিভিল পোশাকে আসা ব্যক্তিরা আগের রাত থেকে ভোটের দিন দুপুর পর্যন্ত বিএনপির নির্বাচনী এজেন্টদের পাকড়াও করতে থাকেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গাজীপুরে বিএনপির দুই থেকে আড়াই শ এজেন্টকে কেন্দ্র অথবা বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টই ছিলেন না। সকালে কেউ কেউ কেন্দ্রে গেলেও পরে চলে এসেছেন বা আসতে বাধ্য হয়েছেন।
গাজীপুরের নির্বাচনের পর ব্যক্তিগত আলাপে পশ্চিমা দেশের একজন কূটনীতিক জানতে চেয়েছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন কি না? তাঁকে জানাই, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন বিদেশি লোককে সাক্ষী রেখে নিশ্চয়ই কেউ ব্যালট পেপারে জবরদস্তি সিল মারবেন না। তবে এ কথাও ঠিক যে বিদেশি কূটনীতিক, পর্যবেক্ষক কিংবা গণমাধ্যম কোনো দেশেই সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কাজটি করতে হয় নির্বাচন কমিশনকেই, প্রয়োজনে তারা জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা নেবে। আইন অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, গাজীপুরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের মতো কাজ করেছেন। নির্বাচনী আইন কিংবা কমিশনকে তোয়াক্কা করেননি।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার বলেছেন, বিএনপির এজেন্ট হিসেবে নাকি কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা যদি মামলার আসামি হবেন, তাহলে ভোট গ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলো কেন? তিনি অস্বীকার করলেই ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য–প্রমাণ মিথ্যা হয়ে যায় না। যেকোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত শান্তিপূর্ণ ও অভয় পরিবেশ। অথচ গাজীপুরে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ভয়ের পরিবেশ ছিল, ভোটের দিন সেটি আরও ভয়ংকর রূপ নেয়।
মাহ্‌ফুজ আনাম লিখেছেন, নির্বাচনে দুটি পক্ষ জয়ী হয়। প্রথমত, নির্বাচনে জয়লাভকারী প্রার্থী। দ্বিতীয়ত, এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা। প্রতিটি ভোটার নির্বাচনে তাঁর ভোট প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার পর তাঁকে এই আস্থা নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে যে তিনি অবাধে ভোট দিতে পেরেছেন এবং তাঁর ভোট গণনা হয়েছে। এর প্রভাব অনেক বেশি। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, গাজীপুরের ভোটাররা কি এই সন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছেন? আবার নিজেই নোবেলজয়ী গীতিকার বব ডিলানের গানের পঙ্‌ক্তি ধার করে উত্তর দিয়েছেন, প্রিয় পাঠক, যা হয়েছে, তা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আমরা যেমন মাগুরা মার্কা নির্বাচন চাই না (সম্প্রতি আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যে কথা দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন), তেমনি চাই না গাজীপুর মার্কা নির্বাচনও।
যেসব গণমাধ্যমকর্মী ২৬ জুন গাজীপুরে ‘ভোট দর্শন’ করেছেন, তাঁরা ভোটকেন্দ্রের বাইরে ও ভেতরে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি যতটা না দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছেন নৌকার প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকদের আগাম ‘জয়োল্লাস’। গোপন ব্যালটে ভোট হওয়ার কারণে ফল প্রকাশের আগে জানা সম্ভব নয় কোন প্রার্থী জয়ী হবেন। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে নৌকা ব্যাজধারীদের একাধিক ক্যাম্প ছিল, যেখান থেকে ভোটারদের স্লিপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ভোটকেন্দ্রের সামনে ধানের শীষের ক্যাম্প ছিল না। দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কাউকে ধানের শীষের ব্যাজও পরতে দেখিনি।
গাজীপুরে ২০১৩ সালে ভোট গণনার আগ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেননি, কে জিতবেন। ভোট গ্রহণের পরও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থী—উভয়ই জয়ের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন। অর্থাৎ যেই জিতুন, লড়াইটা ছিল সমানে সমান। এবার লড়াইটা হয়েছে অসম। ভোটের আগেই কেন্দ্রে গিয়ে যেকোনো ব্যক্তি বলে দিতে পারতেন কে জিতবেন। যে নির্বাচনে ভোটের আগেই জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়, সেটি আর যাই হোক সুষ্ঠু বা অবাধ নির্বাচন নয়। 
সরকারের সমর্থক অনেকেই প্রশ্ন রেখেছেন, বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টরা পালিয়ে গেলেন কেন? ভয়ভীতি, অত্যাচার–নির্যাতন সহ্য করে যদি তাঁরা সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতেন, তাহলে ভোটের পরিবেশটি ঠিক থাকত। তাঁদের উদ্দেশে সবিনয়ে বলতে চাই, নির্বাচন তো মারামারি, লাঠালাঠির বিষয় নয়। নির্বাচন হলো নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যম। সেখানে জবরদস্তির কোনো অবকাশ নেই। কেন্দ্রের বাইরে যাঁরা জবরদস্তির রাজনীতির (হরতাল–সহিংসতাসহ) বিরোধিতা করেন, তাঁরা কেন ভোটকেন্দ্রে জবরদস্তি চালাতে গেলেন? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]