ভাইয়া ওরা শুনতে পাচ্ছে, বলতেও চাইছে

হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম। ছবি: সংগৃহীত
হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম। ছবি: সংগৃহীত

ভাইয়া, তোমরা স্বপ্ন ছিল প্রতিবন্ধী শিশুরা শুনতে পাবে, কথা বলতে পারবে, হাঁটতে পারবে, খেলতে পারবে, গাইতে পারবে। সুস্থ হয়ে তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে আসবে। এ লক্ষ্যে সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তুমি প্রতিষ্ঠা করেছিলে ব্লুমস বিশেষায়িত বিদ্যালয়। তোমার সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কানে শুনতে না পাওয়া শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুটি আজ ডাকে সাড়া দিচ্ছে। নিজের নামটিও বলার চেষ্টা করছে।

তোমার রেখে যাওয়া ৪০ জন প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে ১৪ জনকে হিয়ারিং এইড দেওয়া হয়েছে। তারা এখন শুনতে পায়। তুমি হয়তো বহুবার শ্রবণপ্রতিবন্ধী নাজমুল, সবুজ, প্রসেনজিৎ, আখিঁ, আসলাম, মর্জিনা, আলমগীর, মহিদুর, উজ্জ্বল, রিয়া, সিনথিয়া, মিমকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়েছ। কিন্তু তাতে কোনো সাড়া পাওনি। কিন্তু এখন ঠিকই নাম ধরে ডাকলে তারা সাড়া দিচ্ছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলতেও চায় হয়তো। এদের মধ্যে প্রসেনজিৎ, নাজমুল, উজ্জ্বল কিন্তু নিজের নামও বলতেও চেষ্টা করছে। তোমার জীবদ্দশায় এ দৃশ্য দেখলে কতটা খুশি হতে জানি না। তবে ওদের পরিবারের হাসিতে তুমিও ওপারে আনন্দিত নিশ্চয়ই? হাঁটতে এবং সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারা রাজকুমার, জহিরুল, বৃষ্টি, সিদ্ধা, মিতুকে কেএফও দেওয়া হয়েছে। এখন তারা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বৃষ্টি, সিদ্ধা আর মিতু তো দাঁড়াতেই পারে এখন। আমাদের প্রাপ্তির খাতা বড় হচ্ছে আর ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে। সমাজের প্রতি সমাজের মানুষের প্রতি যে দায় তুমি আমাদের শিখিয়েছ, সেটি পূরণই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য।

আজ তোমার প্রতিষ্ঠিত ব্লুমস কাটিগ্রাম শুধু কাটিগ্রাম বাসীদের স্বপ্নের জায়গায় পরিণত নয়, দূর-দূরান্ত থেকে আবাসিক বিদ্যালয় ভেবে একটু সুচিকিৎসার প্রত্যাশা নিয়ে অনেকেই আসছেন এখানে। কিন্তু আবাসিক না হওয়ায় ব্যর্থতার দায় নিয়ে আপাতত তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে আমাদের।

গত শুক্রবার মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট থেকে সজল মিয়া তাঁর অটিস্টিক ছেলে পারভেজকে নিয়ে এসেছিলেন। আবাসিক না হওয়ায় আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা সজলকে সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। মলিন মুখে সজল মিয়া চলে গেলেন সত্য তবে প্রতিষ্ঠানের জন্য শুভকামনা এবং আবাসিক হলে তাঁর সন্তানকে এই প্রতিষ্ঠানে দ্রুত নিয়ে আসতে পারবেন, সেই কামনাও করে গেলেন। আমি দেখেছি অসহায় পিতার চোখে তোমার প্রতিষ্ঠানের প্রতি তোমার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

ভাইয়া, তুমি আজ আর আমার ভাই নও, তুমি এখন আমাদের ভাই হয়ে গেছ। তুমি এখন এককভাবে কারও সন্তান নও তুমি এখন হাজারো মায়ের সন্তান। তোমার বন্ধুদের লেখা কবিতার ভাষায় তুমি—

জীবনের অধিক মৃত্যু হয় যার
তাঁকে মনে রাখে বিপুল সংসার
এই দেশে তাই তোমার মুখচ্ছবি
নিশীথের চাঁদ, দিবসের রবি।
তুমি রবিউল করিম, তুমি বীর
তুমি না মায়ের না ভাইয়ের না স্ত্রীর
তুমি মহাকালের মহা সন্তান
তুমি নিলে তাই সর্ব হৃদয়ে স্থান।

ভাইয়া, আজ তুমি আমাদের সকলে মাঝে বেঁচে আছ তোমার কর্মে। তোমার মেয়ে কামরুন নাহার রাইনা বড় হচ্ছে। তোমাকে আব্বু বলে ডাকতে শিখেছে। অনেকগুলো ছবির মধ্যে তোমাকে খোঁজে বের করে আব্বু ডাকে।

তোমার ছেলে সাজিদুল করিম সামি তোমাকে দেখার প্রত্যাশায় গোঁমড়া হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় মুখ ফসকে বলে ফেলে আব্বুকে এনে দাও, দেখতে চাই, আব্বুকে নিয়ে মিনি চিড়িয়াখানায় যাব ঘুরতে।

শামসুজ্জামান শামস: হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিমের ভাই