আমরা ইঁদুর নই, মানুষ

গত ২৪ জুন প্রথম আলোয় আমার লেখা ‘আমরা মানুষ না ইঁদুর’ শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশের পর পাঠকদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। অধিকাংশ পাঠকের বক্তব্য হলো, অতিরিক্ত জনঘনত্বের ফলে বাংলাদেশে মানুষের জীবন ইঁদুরের জীবনের মতোই হয়েছে। কেউ কেউ লিখেছেন, আমাদের অবস্থা এখন ইঁদুরের চেয়ে খারাপ।
ইঁদুরের প্রসঙ্গটি এসেছে আমেরিকান বিজ্ঞানী জন ক্যালহুনের একটি গবেষণার সূত্রে। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি ইঁদুর নিয়ে একটা গবেষণা করে দেখতে পেয়েছিলেন, ইঁদুরের বসবাস ও চলাফেরার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় সংখ্যা খুব বেশি বেড়ে গেলে তারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। তখন তারা পরস্পরকে কামড়ায়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, অকারণে অশান্তি সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে সব সময় ঠেলাঠেলি, মারামারি, কামড়াকামড়ি লেগেই থাকে। কিছু পুরুষ ইঁদুর ভীষণ হিংস্র হয়ে ওঠে। তারা মেয়ে ও বাচ্চা ইঁদুরদের অকারণে আক্রমণ করে; তাদের যৌন আচরণে বিকৃত হিংস্রতা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত এমন সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় যে তারা আর সুস্থ-স্বাভাবিক ইঁদুরের মতো আচরণ করতে পারে না।
ইঁদুরের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ বসবাস ও বিচরণের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় তাদের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে সামগ্রিক আচরণগত বিপর্যয় ঘটে—জন ক্যালহুনের এই পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে আমার নিবন্ধটিতে পাঠকদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল: ইঁদুরদের এই অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশে আমাদের জীবনযাপনের সামগ্রিক চিত্র তুলনা করে দেখলে কোনো মিল পাওয়া যায় কি না। তার উত্তরে কিছু পাঠক আমাকে লিখেছেন, তাঁরা মনে করেন, অনেক মিল পাওয়া যায়।
অবশ্য ইঁদুরের সঙ্গে মানুষের তুলনা করা কতটা সংগত, তা নিয়ে বিজ্ঞানী-গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। তাঁদের একাংশ বলেন, ইঁদুর-সমাজের এই চিত্র মানুষের সমাজের জন্য খাটে না। জনঘনত্ব খুব বেশি হলেই মানুষের মধ্যে হিংস্রতা, হানাহানি বেশি হবে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেমন নেদারল্যান্ডসের জনঘনত্ব আমেরিকার জনঘনত্বের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি; সেই হিসাবে নেদারল্যান্ডসে খুনোখুনিসহ বিভিন্ন সহিংস অপরাধের মাত্রা আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো: আমেরিকায় মানুষ হত্যা (হোমিসাইড) ও অন্যান্য সহিংস অপরাধ নেদারল্যান্ডসের তুলনায় অনেক বেশি।
বিজ্ঞানীদের আরেক অংশ বলে, জনঘনত্ব বেশি হলে মানুষের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়ে। তবে তার মাত্রা ইঁদুর বা অন্যান্য মানবেতর প্রাণীর মতো নয়। খুন, ধর্ষণ ও অন্যান্য সহিংস অপরাধের সঙ্গে জনঘনত্বের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক খুব স্পষ্ট নয় বটে, কিন্তু একেবারেই যে নেই, তা-ও প্রমাণ করা যায়নি। তবে কিছু আচরণগত সমস্যার লক্ষণ ধরা পড়েছে। যেমন আমেরিকার স্কুলের শিশুদের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, যেসব স্কুলে শ্রেণিকক্ষ ও খেলাধুলার জায়গার তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, যেখানকার শিশুদের মধ্যে ইরিটেশন বা বিরক্তি, খিটমিটে আচরণ, মাইল্ড অ্যাগ্রেশন বা ছোটখাটো মারামারির ঘটনা বেশি ঘটে। আর ইউনিফর্মড সার্ভিসেস ইউনিভার্সিটির ছাত্রাবাসগুলোতে দেখা গেছে, এক ঘরে বেশিসংখ্যক ছাত্র থাকে, এমন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা আড্ডা, মেলামেশার জন্য কম সময় দেয়, ঘরের দরজা সব সময় বন্ধ রাখতে বেশি পছন্দ করে।
জনঘনত্ব বেশি হলে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বেশি হয়, এটা নিয়ে অবশ্য তেমন বিতর্ক নেই। আর স্ট্রেস বেশি হলে মানুষের আচরণগত অবনতি ঘটতে পারে, এমন কথাও বিজ্ঞানীরা বলেন। তবে বেশি জনঘনত্বের কারণেই মানুষ খুনোখুনি ও অন্যান্য সহিংস আচরণ বেশি মাত্রায় করে, এটা প্রমাণিত হয়নি। এর কারণ জনঘনত্বের মানসিক চাপ বিভিন্ন সমাজ বিভিন্নভাবে সামলে নিতে পারে। কোন সমাজ কীভাবে সামলায়, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইনি ও বিচারিক ব্যবস্থা, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদির ওপর।
গবেষকেরা জনঘনত্বের চাপের ফলে মানুষের পারস্পরিক আচরণের অবনতি লক্ষ করেছেন পাবলিক প্লেস বা জনসমাবেশের জায়গাগুলোতে। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সমাজের সাংস্কৃতিক ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, সমুদ্রসৈকত, খেলার মাঠ, পাবলিক কনসার্ট ইত্যাদি জনাকীর্ণ স্থানে অতিরিক্ত ভিড়ের চাপ বিভিন্ন সমাজ বিভিন্নভাবে সামলায়।
ইউরোপের কোনো কোনো শহরে জনঘনত্ব অনেক বেশি, কিন্তু তাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা ও জনসমাবেশের জায়গাগুলো বেশ সুশৃঙ্খল। হংকং, সিঙ্গাপুর বা টোকিওর মতো জনবহুল শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা, জনশৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সামগ্রিক সৌন্দর্যের সঙ্গে ভারতের মুম্বাই বা আমাদের ঢাকা শহরের তুলনাই করা যায় না।
বাংলাদেশের জনঘনত্ব অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। পৃথিবীতে যেসব দেশের জনসংখ্যা ১০ কোটির বেশি, সেগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জনঘনত্ব ২০০৮ সালে ছিল পাঁচ গুণ বেশি। তার পরের এক দশকে তা আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল দুই দেশ চীন ও ভারতের জনঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। খুব ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের মধ্যে আমরা প্রায় ১৭ কোটি মানুষ বাস করছি, খেয়ে-পরে বেঁচে আছি বললে কমই বলা হবে, বরং আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে, আয়ু বাড়ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমরা বিপুল সংখ্যায় বংশ বিস্তার করে চলেছি। জন্ম-মৃত্যু যোগ-বিয়োগ করার পর প্রতিবছর আমাদের সংখ্যা বাড়ছে ২০ থেকে ২২ লাখ করে। অর্থাৎ আমাদের জনঘনত্ব খুব বেশি, এই সত্যের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক সত্য হলো, আমাদের জনঘনত্ব এখনো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং এভাবে চললে আগামী ৭০-৮০ বছর ধরে তা বাড়তেই থাকবে।
বেশি জনঘনত্বের ফলে আমাদের সমাজে পরিপূর্ণ নৈরাজ্য নেমে আসেনি, বাংলাদেশ এখনো বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে ওঠেনি, এটা ভেবে যাঁরা সান্ত্বনা বোধ করেন কিংবা যাঁরা বলেন, বড় জনগোষ্ঠী কোনো বোঝা নয়, বরং শক্তি, তাঁরা স্রেফ কতগুলো পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন। জনসংখ্যা বাড়লে খাদ্য, পানিসহ জীবন ধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছুতেই টান পড়ে। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ, কিন্তু আমাদের কৃষিজমির পরিমাণ জনসংখ্যার তুলনায় খুবই কম। জনসংখ্যা অবিরামভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে কৃষিজমির পরিমাণ আরও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত দুই দশকে প্রায় ৩০ লাখ একর কৃষিজমি কমে গেছে, এর মধ্যে ৫৫ শতাংশই ব্যবহৃত হয়েছে ঘরবাড়ি বানানোর কাজে। প্রতিবছর ৮২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমাদের নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে না; বরং অদূর ভবিষ্যতে আমরা গুরুতর খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে পারি। তা ছাড়া জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে জমির দাম বাড়তে থাকবে এবং জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত গুরুতর সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করবে। এখনই মামলা-মোকদ্দমার সবচেয়ে বড় অংশটি জমিজমা-সংক্রান্ত। ভূমিহীন মানুষের হার বাড়তে বাড়তে প্রায় ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে, তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশই ভূমি হারিয়েছে ভূমিদস্যুদের কাছে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা, যা ভবিষ্যতে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার পথে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে
দেখা দেবে।
জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে নদী-নালা-খাল-বিল ও বনজঙ্গল উজাড় হচ্ছে, আমরা কলকারখানা স্থাপনের উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না, এসব কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বলা দরকার যে এভাবে চললে একটা সময় আসবে, যখন শুধু সুন্দরবন নয়, কোনো বনজঙ্গলই এ দেশে অবশিষ্ট থাকবে না। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দুর্যোগ-দুরবস্থার মধ্যে আমরা পড়তে যাচ্ছি, তা মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে। অন্যদিকে আমরা যেসব উন্নয়নের কথা বলছি, চলতি হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সেসব উন্নয়নও টেকসই হবে না, বরং পেছনের দিকে যাত্রা শুরু হবে।
কারণ, আমাদের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আকার আরও বড় হচ্ছে এবং কর্মক্ষম বয়সের মানুষের বয়স বাড়ছে। এই মুহূর্তে ১৫ বছর থেকে ৪৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তাঁরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ। তাঁদের বয়স যখন বাড়বে, একটা পর্যায়ে কর্মক্ষম বয়স পেরিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে এবং তাঁরা হবেন জাতীয় অর্থনীতির ওপর একটা বিরাট বোঝা।
এশিয়ার সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ জাপান, সেই দেশও তাদের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর চাপ সামলাতে হিমশিম
খেয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবস্থা কেমন হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।
আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যে এতটাই বৃহৎ হয়ে গেছে যে তা আর শক্তি নেই, বোঝায় পরিণত হয়েছে। এই মর্মান্তিক সত্য হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে তরুণসমাজ, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে দেখতে পাচ্ছে চাকরি নেই। প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ লাখ স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণী চাকরিপ্রার্থীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন—এই পরিসংখ্যান দেখে সুইডেন-নরওয়ের মতো ধনী ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কী করতেন, ভেবে পাচ্ছি না। উল্লেখ্য, সুইডেনের মোট জনসংখ্যা ৯৯ লাখ, নরওয়ের ৫২ লাখ। যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যা সাড়ে ৬ কোটি আর বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যাই ৪ কোটির বেশি। একটি শ্রেণিকক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থীর বসার জায়গা হয়, কিন্তু সেই শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫০, এমন কলেজ বাংলাদেশে অনেক আছে। চিকিৎসাব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা যত সমস্যা দেখতে পাই, তার অধিকাংশের মূল কারণ হলো রোগীর সংখ্যা অত্যধিক। ট্রাফিক ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশনসহ সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পাড়া-মহল্লার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে।
সহজ কথায়, আমাদের জনসংখ্যা এত বেশি বেড়েছে যে কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলছে না। আমরা মানুষ বলে জন ক্যালহুনের ইঁদুর-সমাজের মতো আচরণ করছি না বটে, কিন্তু জীবনযুদ্ধে আমাদের অবস্থা ইঁদুরদৌড়ের মতোই।

মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
[email protected]