খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে

গল্পটি পুরোনো। চর্বিতচর্বণ মনে হবে কারও কারও। তবু উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

রাজার হাতিশালে হাতি কমে গেছে। ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। কেননা পাশের রাজ্যের হাতিশালে অনেক অনেক হাতি। রাজা আদেশ দিলেন, হাতি ধরে আনো, যেখান থেকে পারো।

হুকুম শুনেই কোতোয়াল বেরিয়ে পড়লেন পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে। জঙ্গল ঘেরাও করে হাতি ধরার কাজে নেমে গেলেন তাঁরা। বনের মুক্ত হাতি কি হাতিশালার বন্দিজীবন চায়? সব হাতি পড়িমরি করে ছুটছে ধরা পড়ার ভয়ে। চারদিকে ভয়ানক চেঁচামেচি, শোরগোল। এমন সময় দেখা গেল, একটা শিয়ালও দৌড়াচ্ছে। পাশাপাশি দৌড়াতে থাকা একটি হাতি তাকে বলল, ‘শিয়াল ভায়া, ওরা তো হাতি ধরতে এসেছে, তুমি পালাচ্ছ কেন?’ শিয়াল ছুটতে ছুটতেই বলল, ‘ওরা যদি আমাকেও ধরে, তাহলে আমি যে হাতি নই, এটা প্রমাণ করতেই ১২ বছর লেগে যাবে। কে চায় এসব ঝামেলায় পড়তে!’

এটি একটি শিশুতোষ গল্প। সব গল্প তো গাঁজাখুরি নয়! বাস্তবতার সঙ্গে মিলে গেলে গল্পগুলো অনেক দিন আয়ু পায়। এটি সে রকম। আমি রাজদ্রোহী নই। পাইক-পেয়াদাদের বিরুদ্ধেও আমার কোনো অভিযোগ বা বিদ্বেষ নেই। আমাদের সার্বিক বিচারব্যবস্থাটি এমন যে এর মধ্যে একবার ঢুকলে বেরোনো খুবই কঠিন। কোনো কোনো শিশুপার্কে এ ধরনের খেলার ব্যবস্থা থাকে। ঢোকার একটি পথ, বের হওয়ার পথ আরেকটি। কিন্তু সেটি খুঁজে পেতে শিশুরা, এমনকি বড়রাও গলদঘর্ম হয়। আমাদের অনেকেই শিশুকালে সাপলুডু খেলেছি। মনে হবে, এই বুঝি জিতে গেলাম। তারপর হঠাৎ করেই দেখি সামনে অজগরের হাঁ-করা মুখ, নিমেষেই গিলে খেয়ে ফেলল।

‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’, এটি অতি পুরোনো কথা। এখানে বিচার পাওয়া না-পাওয়ার আহাজারি ফুটে উঠেছে। প্রাসঙ্গিক বিষয় দুটি। এক. ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। অর্থাৎ অপরাধী সাজা পায় না, নিরপরাধ ব্যক্তি সাজা ভোগ করে। দুই. বিচারপ্রক্রিয়া এত লম্বা সময় নেয় যে নিরপরাধ প্রমাণ করতে করতেই তার আয়ু ফুরিয়ে যায়।

৯ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মুখ থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত পেয়েছি। তিনি জানিয়েছেন, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬৪৯। এর মধ্যে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন আছে ২৮ লাখ ৯২ হাজার ১৩৭টি মামলা। উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ লাখের বেশি (প্রথম আলো, ১০ জুলাই ২০১৮)।

এ দেশে মানুষ বেশি। মামলার সংখ্যাও বেশি। মামলাপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের খ্যাতি আছে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারেও আমাদের জুড়ি নেই। সাক্ষী ধরে এনে তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে আদালতের কাঠগড়ায় তুলে দেন উকিল-মোক্তাররা। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এ রকম উদাহরণ আছে অনেক। উকিলে উকিলে রেষারেষি বা প্রতিযোগিতার কারণেও মামলা চলে ধীরগতিতে। এ এমন এক গ্যাঁড়াকল, একবার যে এর মধ্যে পড়েছে, সে-ই টের পেয়েছে। শান্তিপ্রিয় মানুষ ঝুটঝামেলা এড়াতে চায়। থানা-পুলিশ বা কোর্ট-কাচারির ধারেকাছেও যেতে চায় না। তা না হলে মামলার সংখ্যা আরও বেশি হতে পারত।

অনেকেই বিনা বিচারে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলখানায় আটক থাকেন। মামলা আদালতে গড়ায় না। এ দেশের মামলা তো সাক্ষীনির্ভর। তো সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো গণমাধ্যমে একটি সংবাদ পাওয়া গেল, অমুক ব্যক্তি বিনা বিচারে কিংবা বিনা অপরাধে হাজতবাস কিংবা কারাদণ্ড ভোগ করছেন। হয়তো কোনো এনজিও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উদ্যোগ নেয়, তাঁকে আইনি সাহায্য দিতে এগিয়ে আসে। হয়তো কোনো বিচারক উদ্যোগী হয়ে বিচারাধীন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেন; অথবা বলেন, এত বছরের বেশি দিন ধরে যারা হাজতবাস করছে, তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এগুলো তো হরহামেশা ঘটে না। সহৃদয় বিচারকের নজরে আনতে পারলে তিনি দু-একটা মামলার সুরাহা করে দিতে পারেন। মামলাজট ভাঙতে হলে তো দরকার আমূল সংস্কার। মামলাজট তো এক দিনে হয়নি। শত বছরের জঞ্জাল জমে জমে আজ এ অবস্থা। এক দিনে বা এক বছরে তার নিষ্পত্তি হবে না। কিন্তু শুরু তো করতে হবে।

সাহিত্যের ব্যাপারে উদ্ধৃতি দিতে হলে আমরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রে চলে যাই, কিংবা নজরুল-জীবনানন্দ-সুকান্তর কাছে। রাজনীতির ব্যাপারে আমরা অনেক সময় প্রশ্ন ও উত্তর দুই-ই খুঁজি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। দিনটি ছিল শনিবার। জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন স্পিকার আবদুল মালেক উকিল। সবে চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। সংসদ নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শেষ ভাষণটি দিচ্ছেন। একপর্যায়ে বললেন:

আজকে বিচার বিভাগের কথা ধরুন। আমরা আজকে একটা কোর্টে বিচারের জন্য গেলে, একটা সিভিল মামলা যদি হয়, আপনি তো উকিল, স্পিকার সাহেব—আল্লাহর মর্জি যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয়, তাহলে বিশ বছরেও কি সেই সিভিল মামলা শেষ হয়—বলতে পারেন আমার কাছে? বাপ মারা যাওয়ার সময় বাপ দিয়ে যায় ছেলের কাছে, আর উকিল দিয়ে যায় তার জামাইয়ের কাছে সেই মামলা। আর ক্রিমিনাল কেস হলে লোয়ার কোর্টের মামলা জজকোর্টে—বিচার নাই। জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। উই হ্যাভ টু মেক আ কমপ্লিট চেঞ্জ এবং সিস্টেম আমাদের পরিবর্তন করতে হবে, যেন ইজিলি মানুষ বিচার পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার পায়।

সমস্ত কিছুর পরিবর্তন দরকার। কলোনিয়াল পাওয়ারের রুল নিয়ে দেশ চলতে পারে না। কলোনিয়াল পাওয়ারে দেশ চলতে পারে না।

নতুন স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মতবাদ, স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে হবে। সেখানে জুডিশিয়াল সিস্টেমের অনেক পরিবর্তন দরকার। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। কোনো কথা শুনব না।

৯ জুলাই সংসদে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আইন ও বিচার বিভাগ দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে বিচারকাজ ত্বরান্বিত করতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো এবং এজলাস-সংকট নিরসনে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির এবং তাঁর জানামতে, ‘আপিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি চিন্তাভাবনা করছেন।’

খুব ভালো কথা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে ৪৩টি বছর। অনেক দিন নাহয় বঙ্গবন্ধুর দল সুস্থির হয়ে বসতে পারেনি। এখন তো তাঁরা ক্ষমতায় আছেন টানা ১০ বছর। এ ব্যাপারে তাঁরা কী কী ‘কার্যকর পদক্ষেপ’ নিয়েছেন, তা জনগণকে জানানো দরকার। এ ক্ষেত্রে ‘দেখছি’, ‘ভাবছি’, ‘চিন্তাভাবনা করছি’, এসব কথার কোনো মানে হয় না। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে আপিল বিভাগ পর্যন্ত সমগ্র বিচারব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। এ জন্য দরকার অনেক আয়োজন, বিপুল বিনিয়োগ। বাজেটের দিকে তাকালে তো তার ছিটেফোঁটাও নজরে পড়ে না।

বিচারব্যবস্থার সংস্কার শুধু আদালতকেন্দ্রিক হলে চলবে না। এ জন্য দরকার প্রয়োজনীয় আইন-সংস্কার এবং পুলিশ প্রশাসনের দক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়ানো। একটি সামগ্রিক সংস্কার পরিকল্পনার আওতায় বিষয়গুলো সমন্বয় করতে হবে। এটাকে দাতা সংস্থার অনুদানে নিছক একটা ‘প্রজেক্ট’ হিসেবে নিলে চলবে না। সরকারের ভেতর থেকেই তাগিদটা আসতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে রাষ্ট্রের প্রবল ইচ্ছাশক্তি। রাষ্ট্র চাইলে সবকিছুই হয়।

মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
[email protected]