এরপরও আমরা বাসে চড়ব!

সাইদুর রহমান। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
সাইদুর রহমান। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

দীর্ঘ বাসভ্রমণে যেকোনো যাত্রীর ‘বাথরুম’ পেতেই পারে। আর বাস যদি কোনো কারণে থেমে থাকে, তখন হালকা হতে বাস থেকে সেই যাত্রীর নেমে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ওই যাত্রী না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা চালকসহ বাসের সব কর্মীর অপরিহার্য দায়িত্ব। এ দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়ানোর প্রশ্ন নেই। কিন্তু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান ওরফে পায়েলের বেলায় মোটেও সে দায়িত্ব পালন করা হয়নি। তিনি ফিরেছেন কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়েই বাসটি চলতে শুরু করে।

এ সময় বাসে ফিরতে থাকা সাইদুরের দিশে হারিয়ে দৌড় দেওয়াটা স্বাভাবিক। বাস হারালে এত রাতে তিনি যাবেন কোথায়? তার ওপর মোবাইল ফোনটিও ফেলে এসেছেন বাসে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় নেই। তাই পড়িমরি করে বাসে উঠতে গেলেন তিনি। নাকে-মুখে পেলেন প্রচণ্ড আঘাত। তারপর ধরাশায়ী। এ সময় বাসের কর্মীদের একমাত্র কর্তব্য ছিল সাইদুরকে দ্রুত কাছের কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এর বদলে তাঁদের মাথায় ভয়ংকর ভাবনার উদয় ঘটে। দুর্ঘটনার দায় এড়াতে আহত সাইদুরকে তাঁরা নদীতে ছুড়ে ফেলেন। এই তিনজন হলেন চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজার। গতকাল বুধবার মুন্সিগঞ্জের আদালতে এমনই জবানবন্দি দিয়েছেন সুপারভাইজার মো. জনি। এই বর্বরতার পরিণতিতে গজারিয়ার ভবের চরে লাশ পাওয়া যায় সাইদুরের। সে এমন এক লাশ, যার দিকে তাকানো যায় না।

মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তির উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। কিন্তু এই আদিম নৃশংসতার কোনো সীমা নেই। সৃষ্টি সেরা জীব বলে পরিচিত মানবকুলে এমন ভয়ংকর নজির যখন থাকে, তখন নিজের স্বরূপ নিয়েও সংশয় দেখা দেয়। আমরা মানুষ, না অন্য কিছু?

আমাদের দেশে বাসকেন্দ্রিক বর্বরতার ঘটনা নতুন নয়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটেছে। যাত্রী ও পথচারীদের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে প্রায়ই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন চালকেরা। এই তো গত এপ্রিলেই দুই বাসের রেষারেষিমূলক প্রতিযোগিতায় একটা হাত খুইয়ে প্রাণ দিলেন তরুণ রাজীব। এর কিছুদিন পরই একই রকম ঘটনায় ঝরে গেল ঢাকা ট্রিবিউনের কর্মী নাজিম উদ্দিনের প্রাণ। বাসের কর্মীরা কতটা নির্মম হতে পারেন, এর জ্বলন্ত উদাহরণ টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপা খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। এই নারকীয় সিরিজের নতুন সংযোজন সাইদুর নিহত হওয়ার ঘটনা।

তরতাজা তরুণ সাইদুর যখন চট্টগ্রামে মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হন, তখন কি তাঁর মা ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন যে তাঁর এই ছোট ছেলের এটাই শেষ যাত্রা? যে বাসটি তাঁকে বহন করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবে, সে বাসের মানুষই হবে তাঁর জীবননাশের কারণ? একজন মা নয়টি মাস তিলে তিলে নিজ গর্ভে পরম যত্নে লালন করেন সন্তানকে। অপত্যস্নেহে বড় করে তোলেন। সন্তানের একটু হাসিতে মায়ের সব কষ্ট ম্লান। সন্তানের সুখে মায়ের বুকে প্রশান্তি। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতে মায়ের সব সুখ। সেই সন্তান যদি টগবগে তরুণ হয়, সেখানে মায়ের সাধ-আহ্লাদ অনেক বেশি। সাইদুরও ছিলেন মায়ের কাছে তা-ই। সেই সাইদুর যদি হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বিকৃত লাশ হয়ে ফেরেন, তখন তাঁর মায়ের ভেতরটা কী হবে। এটা কল্পনা করা যায় না!

বারবার একই রকম ঘটনার কেন এই পুনরাবৃত্তি? মূল কারণ একটাই—ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সাজা থেকে খুব সহজেই রেহাই পেয়ে যাওয়া। আইনের ফাঁকফোকর, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহায়তা আর বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। দেখা যায়, এসব বাসের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা ও অর্থে অনেক বেশি শক্তিশালী। একটি বাসে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, মালিক তখন ব্যবসা ও নিজের স্বার্থেই মানবতাকে পায়ে দলে চালক ও অন্য কর্মীদের পক্ষ নেন। টাকা ও প্রভাবের কাছে দুর্বল হয়ে যায় আইনের ধারা। তা দেখে অন্যরাও একই ধরনের অপরাধ ঘটানোর দুঃসাহস পায়। বিচার থেকে পার পাওয়ার এই সংস্কৃতি যত দিন চলবে, এ ধরনের বর্বরতা জন্য তৈরি থাকতে হবে সবাইকে। মানুষ যখন গিনিপিগ বনে যায়, তখন অকাতরে এমন প্রাণ বিলানো ছাড়া আর কী করার আছে?

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]