শিশু সুরক্ষা এবং শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিরসন

>১২ জুলাই ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সহযোগিতায় ‘শিশু সুরক্ষা এবং শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিরসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: শিশুর সুরক্ষা ও শাস্তি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। এ বিষয়ে উপস্থাপনার মাধ্যমে আলোচনা করবেন মাহবুবা আক্তার ও তাজুল ইসলাম।

মাহবুবা আক্তার
মাহবুবা আক্তার

মাহবুবা আক্তার
২০০৮-০৯ সালে শিশুদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যায়। ২০১০ সালে ১৪টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে মামলা করি। জনস্বার্থের কোনো মামলায় এই প্রথম ৬ মাসের মধ্যে একটা রায় পাওয়া গেছে।
ব্লাস্টের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিশুর লেখাপড়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শাস্তির প্রয়োজন আছে। ৫৫ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি শিশুকে ভালো হতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে।

তাজুল ইসলাম
তাজুল ইসলাম

তাজুল ইসলাম
আমরা তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য চেয়ে আবেদন করি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর জেলা জজ আদালতে আবেদন করে জানতে চেয়েছিলাম শিশু নির্যাতন–সংক্রান্ত কতগুলো মামলা হয়েছে। মাত্র দুটি মামলার খবর পেয়েছি।
২০১২-১৮ সাল পর্যন্ত ৫৩টি আবেদন করেছি। এ আবেদনে নির্যাতনের শিকার মেয়ের সংখ্যা ৫৩, ছেলে ২২০। এরা সবাই তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। শাস্তিদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে রয়েছে চাকরি থেকে বরখাস্ত, বদলি করা ও থানায় মামলা ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়টির প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

লায়লা খন্দকার
লায়লা খন্দকার

লায়লা খন্দকার
এন্ডিং লিগ্যালাইজড ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন গ্লোবাল প্রোগ্রেস রিপোর্ট মতে, সারা বিশ্বে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ১০০ কোটি শিশু তাদের বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু এন্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন ১৫০টি গবেষণার ফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, শাস্তি প্রত্যক্ষভাবে শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, পরোক্ষভাবে শিশুর মানসিকতাকে বিপর্যস্ত করে। তাদের শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও এর বড় ধরনের নেতিবাচক ভূমিকা আছে। শাস্তি শিশুর মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব তৈরি করে।
শিশু যাঁদের সবচেয়ে বিশ্বাস করে, তাঁদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ নিতে পারে না। এর ফলে শিশু বয়সে যারা শাস্তির শিকার হয়, বড় হলে তারা মনে করে ঘনিষ্ঠজনদের প্রতি সহিংস আচরণ করা যায়। বিশ্বে প্রায় ৫৩টি দেশ আছে, যেখানে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন পাস হয়েছে। শাস্তি থেকে সুরক্ষা পাওয়া শিশুদের মৌলিক অধিকার।

ফেরদৌস নাঈম
ফেরদৌস নাঈম

ফেরদৌস নাঈম
দেশের সব জেলায় আমাদের শাখা রয়েছে। শিশুরা পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তির শিকার হয়। এ বিষয়ে আমরা একটা জরিপ করেছিলাম। শ্রেণিতে চিৎকার-চেঁচামেচির জন্য শিক্ষকেরা দু-একজনকে এমনভাবে সবার সামনে শাস্তি দেন, যেন অন্যরা ভয় পায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল ভালো হয় না।

মেখলা সরকার
মেখলা সরকার

মেখলা সরকার
আমাদের একটা জরিপে দেখা যায়, দেশের ১৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। ২০০৯ সালে শিশুদের নিয়ে আমাদের একটা জরিপে দেখা গেছে, ১৮ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আছে। শিশু যদি আঘাতপ্রাপ্ত না হয় এবং অন্য কাউকে আঘাত করতে না দেখে, তাহলে সাধারণত বিশেষ পরিস্থিতির শিকার না হলে ওই শিশু বড় হয়ে কখনো কাউকে আঘাত করবে না।
সরকার বা বেসরকারি উদ্যোগে প্রতি মাসে অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে পরামর্শ অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। আইনের সঙ্গে অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত সচেতনতার ওপর।

আবদুছ শহীদ মাহমুদ
আবদুছ শহীদ মাহমুদ

আবদুছ শহীদ মাহমুদ
২০১৭ সালে স্কুলে ৪১টি শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ২০১৮ সালে প্রথম ছয় মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৯টি শিশু। শিশু নির্যাতন বন্ধের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীরা জানে না। কিন্তু জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল শিক্ষকদের এটা জানানো।

রেহানা বেগম
রেহানা বেগম

রেহানা বেগম
২০১৫ সালে ১২০টা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গবেষণা করেছিলাম। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
২০১৬ সালে এটা হয়েছে ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আমার সন্তান যে স্কুলে পড়ে, সে স্কুলে নির্যাতনের জন্য এক শিশুশিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এটি জেনে দুদিন ঘুমাতে পারিনি। এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

সাঈদ আহমেদ
সাঈদ আহমেদ

সাঈদ আহমেদ

আমাদের উদ্যোগ হলো শাস্তি হলে কী হবে, সেটি নিয়ে। কিন্তু শাস্তির ঘটনা যেন না ঘটে, এমন উদ্যোগ নেই। উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপও সবার কাছে পৌঁছায় না। জ্ঞান না দিয়ে উৎসাহ বা বিনোদনমূলকভাবে শিশু নির্যাতন বন্ধের বিষয়টি ভাবা দরকার। সিসিমপুর স্কুলের মতো দীর্ঘ মেয়াদে আনন্দময় স্কুলের কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

কাজী ফারুক আহমেদ
কাজী ফারুক আহমেদ

কাজী ফারুক আহমেদ
যাঁরা শিশুদের নির্যাতন করেন, তাঁদের অধিকাংশই শিশু নির্যাতন বন্ধের আইন সম্পর্কে জানেন না। আমরা শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলি। আমাদের সংগঠন ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট থেকে এ বিষয়টি শিক্ষকদের জানানোর উদ্যোগ নিয়েছি। শিশু নির্যতনের বিষয়ে একটা সামাজিক আন্দোলন ছাড়া পরিবর্তন আনা কষ্টকর হবে।

নূরুন নাহার ওসমানী
নূরুন নাহার ওসমানী

নূরুন নাহার ওসমানী
শিশু নির্যাতন বন্ধে নীতি, পরিপত্র ও আইন আছে। যাঁদের এগুলো প্রয়োগ করার কথা, তাঁরাও কাজটি প্রায় ঠিকভাবে করছেন না। এখন স্কুলের শিক্ষার্থী, শিশু গৃহকর্মী, পথশিশু—সবার কথা ভাবতে হবে। শিশুরা প্রথমে আদর্শ মানে মা-বাবাকে। তারপর যে শিক্ষক সবচেয়ে ভালো, তাঁকে। এ জন্য মা-বাবা ও শিক্ষকদের আচরণ শিশুদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের নিজেদের শিশুদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করছি, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে িঠক হলে এটা একটা সামাজিক আন্দোলনের মতো হতে পারে। শিক্ষক নিয়োগের সময়ও দেখতে হবে তিনি কতটুকু শিশুবান্ধব ও মানবিক।

মো. দেলোয়ার হোসেন
মো. দেলোয়ার হোসেন

মো. দেলোয়ার হোসেন
আমরা ৬৫ হাজার স্কুল পরিচালনা করি। এখানে দুই কোটি শিশু রয়েছে। এসব শিশুর অনেকে শাস্তির শিকার হচ্ছে। বিভিন্নভাবে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছি। প্রশিক্ষণের মধ্যে শাস্তি না হওয়ার বিষয়টি এনেছি। নিয়মিত তদারকির মধ্যে এনেছি। আমাদের সংস্কৃতিটাই এমন যে একটুতেই উত্তেজিত হয়ে যাই। জোরে কথা বলি। খুব সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলি। শিক্ষকদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ আছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মায়েদের সচেতন করছি। ভবিষ্যতে শিশু নির্যাতনের বিষয়টি বন্ধ হবে বলে আশা করি।

মো. নিজামুল হক
মো. নিজামুল হক

মো. নিজামুল হক
অনেক পরিবার ও অনেক শিক্ষক মনে করেন, কিছুটা শাস্তি না দিলে শিশুরা মানুষ হবে না। সামাজিক অন্য অবস্থানে যারা গরিব ও ক্ষমতাহীন, তাদের প্রতি ধনী ও মালিকপক্ষের অত্যাচার হয়। আমাদের ছাত্রজীবনে প্রায় সবাইকেই মার খেতে হতো। আজও রংপুরের একজন শিক্ষক একটি শিশুকে শাস্তি দিয়েছেন। তার কান ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিশুটি চিকিৎসাধীন আছে। তবে আগের থেকে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। শিশু নির্যাতন বন্ধ করার জন্য কিছু বাধা আছে। এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। শিক্ষকদের বোঝাতে হবে, এভাবে শাস্তি দেওয়া যায় না। এটি সরকারি আইনে নিষিদ্ধ আছে।

কাজী রিয়াজুল হক
কাজী রিয়াজুল হক

কাজী রিয়াজুল হক
এখন কিছুটা হলেও শিশু শাস্তির পরিমাণ কমেছে। প্রতি জেলায় ডিসিকে প্রধান করে প্রতি মাসে একটা সভা হয়। এ সভায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন। এখানে শিশু নির্যাতন বন্ধের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা হিসেবে রাখার জন্য উদ্যোগ নেব। সরকারের প্রতিনিধিদের এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্যও নির্দেশনা দেব। কাজটি ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেটিও দেখব।
ফরিদপুরে এক সরকারি কর্মকর্তার অন্যায় আচরণে একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এখনকার শিশুরা তার মর্যাদার ব্যাপারে খুবই সচেতন। সমাজ জেগেছে। আমরা যা-ই বলি না কেন, প্রশাসন জনগণের পাশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। চট্টগ্রামে এক শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আত্মহত্যা করেছে।
প্রতি জেলায় মাসে কতটি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিতে হবে। এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটা দেখব। সবাইকে িশশু নির্যাতন বন্ধের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: সমাজের সবার মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক সচেতনতামূলক কাজ করা প্রয়োজন। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন
কাজী রিয়াজুল হক: চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
মো. নিজামুল হক: প্রধান লিগ্যাল অ্যাডভাইজার, ব্লাস্ট; বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত), অ্যাপিলেট ডিভিশন, সুপ্রিম কোর্ট
নূরুন নাহার ওসমানী: সদস্য, শিশু অধিকার কমিটি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি)
মো. দেলোয়ার হোসেন: উপপরিচালক, বিদ্যালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর
কাজী ফারুক আহমেদ: চেয়ারপারসন, ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট
লায়লা খন্দকার: পরিচালক, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
আবদুছ শহীদ মাহমুদ: পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম
মেখলা সরকার: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শ্যামলী
সাঈদ আহমেদ: নির্বাহী প্রধান, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি)
রেহানা বেগম: ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, গণসাক্ষরতা অভিযান
তাজুল ইসলাম: উপদেষ্টা, অ্যাডভোকেসি ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্লাস্ট
মাহবুবা আক্তার: উপপরিচালক, অ্যাডভোকেসি, ব্লাস্ট
ফেরদৌস নাঈম: ডেপুটি স্পিকার, চাইল্ড পার্লামেন্ট, এনসিটিএফ
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
গওহার নঈম ওয়ারা: উপদেষ্টা, প্রথম অালো