তরুণেরা ভুল করে না

নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই অদম্য তরুণেরা নেমে এসেছিল রাজপথে
নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই অদম্য তরুণেরা নেমে এসেছিল রাজপথে

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়/ পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা/ এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়—  / আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।’ প্রথম আলো আঠারো বছর পূর্তিতে সুকান্তের এই কবিতা ধার করেই স্লোগান বেছে নিয়েছিল, ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে এ দেশের কিশোর-তরুণেরা সত্যিই আঠারো নামিয়ে এনেছিল।

শুধু নিরাপদ সড়কের দাবি নয়, তরুণ-কিশোরেরা প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে যে বয়স্কদের পথ দেখায়, তার প্রমাণ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং আশির দশকজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেরও নিয়ামক শক্তি ছিল তরুণেরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলের ছাত্ররা শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে গিয়েছিল। বায়ান্নতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তরুণেরা তাঁদের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভাঙলেন এবং ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। বাষট্টিতেও ছাত্ররা আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেল-জুলুমের শিকার হন। উনসত্তরেও বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। ২৪ জানুয়ারি মিছিল করতে গিয়ে নবকুমার ইনস্টিটিউটের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক নিহত হয়। সৃষ্টি হয় গণ-অভ্যুত্থানের।

সেসব আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এবারের আন্দোলনটি ভিন্ন মাত্রার। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল বিমানবন্দর সড়কে, তা-ই স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল ঢাকা শহরে, সারা দেশে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শুধু আন্দোলন করেনি, তারা কীভাবে সড়ক নিরাপদ রাখা যায়, সেই পথও বাতলে দিয়েছিল। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় কিংবা আইন না মেনে চলায় তারা মন্ত্রীর গাড়ি, সচিবের গাড়ি, পুলিশের কর্তাব্যক্তি ও গণমাধ্যমকর্মীদের গাড়িও আটকে দিয়েছিল। ব্যস্ত সড়কেও কীভাবে সারিবদ্ধভাবে যান চালাতে হয়, সেসবও এই শিক্ষার্থীরা আমাদের মতো বয়স্কদের শিখিয়েছে।

পরবর্তী কালে কিশোর-তরুণদের এই আন্দোলনকে কারা বিপথে চালিত করেছে, কারা আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করেছে, কারা আন্দোলন দমনের নামে লাঠিসোঁটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেসব অনুসন্ধান করা জরুরি। সরকার শুধু ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কার গায়ে কী রঙের কাপড় ছিল, সেটি দেখে উসকানিদাতাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউ উসকানি দিলে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে সরকার তাদের ধরুক। কিন্তু নিছক সন্দেহের বশে শিক্ষার্থীদের পাইকারি  গ্রেপ্তার করা হলে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়।

কয়েক দিন আগে এক টিভি টক শোতে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বেশ জোর দিয়ে বললেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। কাউকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে না। পুলিশ কমিশনারের এই বক্তব্য ঠিক হলে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী শেখ তানিম আফরোজ ইমি গ্রেপ্তার হলেন? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর কারণে চারজন মেয়েকে খুঁজছিল পুলিশ এবং তারা ভুল করে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযোগের বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো, জানতে চাইলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আবদুল বাতেন বলেছেন, ‘সেই কৈফিয়ত দিতে তিনি বাধ্য নন।’   

একজন নিরীহ নারী শিক্ষার্থীকে রাতে ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে যাওয়া হবে, আর পরে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে কোনো কৈফিয়ত দেবেন না। এটি কী ধরনের আবদার? কথায় কথায় আমরা বয়স্করা তরুণদের দোষারোপ করি। তাদের সামান্য ভুলত্রুটি বড় করে দেখি। কিন্তু আমরা বয়স্করা মস্ত বড় ভুল করলেও কৈফিয়ত দিতে চাই না। সেটি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজটি চলছে বয়স্কদের আত্মম্ভরিতায়। তরুণদের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বিপদটা এখানেই।

২.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তাঁর অভিজ্ঞতা ও ভয়ের কথা জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন আমাকে। পত্রিকায় লেখালেখি করি। এ কারণে তিনি আশা করছেন তাঁর ভয় আমরা দূর করতে পারব। চার পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা ওই চিঠিতে শুধু বেদনা ও কষ্টের কথা আছে। আছে শঙ্কা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা। এখানে তাঁর চিঠির চুম্বক অংশ তুলে ধরছি:

‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকালীন সময় অতিবাহিত করছে। কিছুদিন আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে, যে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করেছিল বৈষম্যমুক্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু তা হয়নি। আজ আমরা স্বাধীন দেশে বৈষম্যের শিকার। আমরা কোটা প্রথার বাতিল চাইনি, চেয়েছিলাম সংস্কার এবং তা অবশ্যই যৌক্তিক সংস্কার। এই আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হামলাকারীরা কেউ গ্রেপ্তার হননি। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। যারা হামলা করল তারা তার বাইরে আর যারা হামলার শিকার তাদের অনেকে জেলে। কেন এমন হবে স্যার? আইন কি সবার জন্য সমান নয়? পুলিশের সামনে হামলাকারী মারবে আর পুলিশ তা দেখবে, পুলিশ বাহিনীর কাজটা কি স্যার? ...এ দেশে যারা নাগরিক প্রত্যেকের অধিকার আছে ন্যায়সংগতভাবে দাবি জানানোর। একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার সবার রয়েছে।’

পত্রলেখক নিজের নাম-ঠিকানা দেননি। লিখেছেন, ‘আমার নাম–ঠিকানা লিখলাম না স্যার। কারণ, আমি খুন বা গুম হলে এ রাষ্ট্রের কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু আমি আমরা বিধবা মায়ের চোখের জলের কারণ হতে চাই না।’

তাঁর চিঠিটি পড়ে কোটা আন্দোলনের অন্যতম নেতা কারাগারে আটক রাশেদের মায়ের মুখ ভেসে উঠল। আইসিটি আইনে মামলা করার পর রাশেদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আদালতে, আদালত থেকে রিমান্ডে আবার ডিবি অফিসে। রাশেদকে দেখে মা বিচলিত হন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে এই বলে আরজি জানান, ‘ওকে যেন আর না মারে।’

কোটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল কয়েক মাস আগে। তারপর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে। আন্দোলনকারীদের বেশ কজন জেলে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার ভয়ভীতির মধ্যে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ সাহস নিয়ে তাঁদের দাবির কথা পুনর্ব্যক্তও করেছেন। তাঁরা ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, সরকার যদি সত্যিই কোটা সংস্কারের ব্যাপারে আন্তরিক হয়ে থাকে তা হলে ঈদের আগে বন্দী শিক্ষার্থীদের মুক্তি, সুশাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও পাঁচ দফার ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি করুন।

রাশেদের মা-ও বলেছেন, ‘আমার ছেলে জেলে আছে। ঈদের আগে ছেলেকে ছেড়ে দিন। না হলে আমার ঈদ হবে না।’ এই আর্তি শুধু রাশেদের মায়ের নয়। কোটা ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের সবার মায়ের, স্বজনের।

৩.

নারী উদ্যোক্তা বর্ণালী চৌধুরী লোপা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসরিকুল আলম কিংবা গাজী ইমাম বুখারি সিফাতের মতো আরও অনেককে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছেন। আটককারীরা বলেছেন, তাঁরা গুজব ও মারধরের ঘটনায় জড়িত। কিন্তু কোনো তথ্য–প্রমাণ নেই। বর্ণালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খাবার দিয়েছেন। আমরা দেখেছি, অনেকে শিক্ষার্থীদের খাবার দিয়েছেন। পানির বোতল, চকলেট ইত্যাদি দিয়েছেন। এদের সবাই কি ষড়যন্ত্রকারী ও উসকানিদাতা?

আমাদের জানা ছিল না বাংলাদেশের পুলিশ এত দুর্বল ও অদক্ষ। যাঁরা ছাত্র আন্দোলনের সুযোগে গুজব ছড়িয়েছেন বা নাশকতার মতো মারাত্মক অপরাধ করেছেন, পুলিশ তাঁদের ধরতে পারবে না। তাঁদের ধরার জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সহায়তা নিতে হবে? ঘটনাটি যদি উল্টো হতো। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর আক্রমণকারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধরে এনে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে বলত, এরা গোলযোগ করেছে, আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে অশান্ত করে তুলেছে, তাহলেও কি পুলিশ একই আচরণ করত? অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করত, রিমান্ডে নিত?

আন্দোলনে যে অনুপ্রবেশকারী বা সুযোগসন্ধানী থাকতে পারে না, সে কথা আমরা বলছি না। এ ধরনের ঘটনায় অনেকে সুযোগ নিতেই পারে। সরকার তাদের ধরুক। কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু আমরা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি তাহলে জুজুর ভয় দেখিয়ে সন্দেহের বশে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার কিংবা কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার এই মহড়া বন্ধ করতেই হবে।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]