আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া?

শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ক্ষান্ত দিলেও এর রেশ কাটেনি। দুদিক থেকে এর প্রভাব কার্যকর থাকছে। এক দিকে এ আন্দোলন সড়কে নিরাপত্তার অভাবের চিত্রটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ায় সংকটের পুঞ্জীভূত রূপটি আমরা দেখতে পেলাম। সরকার বিব্রত হলেও এমন বাস্তব সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনকে বিবেচনায় নিতে হয়েছে। সবাই বোঝে, বহুদিনের অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফলে সড়কে যে বহুমাত্রিক জঞ্জাল পুঞ্জীভূত হয়েছে, তা সাফ করা সহজ কাজ নয়, চটজলদি সমাধানও এর হবে না। কিন্তু সরকারকে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনে হাত দিতে হয়েছে। আর তাতে স্কাউট, গার্ল গাইডসের মতো শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা হাত লাগিয়েছে। ৭ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহ ১০ দিন ধরে হয়েছে, গাড়ির ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স কড়াকড়িভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাতে মামলা আর জরিমানা আদায় বেড়েছে, রাস্তায় গণপরিবহন কমেছে, রাজধানী ও জেলায় জেলায় বিআরটিএ দপ্তরে কাগজপত্র হালনাগাদ করার হিড়িক পড়েছে। তবে এখনো সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমেনি। এর জন্য পরিকল্পিতভাবে মৌলিক সংস্কারকাজে হাত দিতে হবে, সে কাজ শুরু হয়েছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। আন্দোলনের প্রভাবে সূচিত ইতিবাচক পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হবে কি না, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।

আন্দোলনের প্রভাব অন্যদিক থেকেও অনুভূত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক উভয় আন্দোলন নিয়ে উসকানি, ষড়যন্ত্র, নাশকতার অভিযোগ উঠেছে এবং সেই সূত্রে সরকার তার রুদ্র রূপ প্রদর্শন করে সবার কাছে একটি বার্তা দিতে চাইছে। এতে স্বভাবতই সমাজে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বিষয়টি জটিল, তলিয়ে বিচার করে দেখা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে মানুষ সহজেই ভাবাবেগে ভেসে যায়, হুজুগে মেতে ওঠে। ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছিল একটি ন্যায্য কারণে। কিন্তু যদি এ ধরনের অসংগঠিত নাগরিক আন্দোলন দীর্ঘায়িত হয়, তবে তার বিপদ অনেক। বিশেষত, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও অধিকার শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে বেশি দিন রাখতে দেওয়ার বিপদের দিকটিও সবার ভাবা দরকার। এভাবে রাস্তায় নেমে ট্রাফিকের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়া একটি অভূতপূর্ব ঘটনা এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যতিক্রমী; ভুক্তভোগী মানুষ এতে কেন সাড়া দিয়েছে, তা সবাই বুঝেছি। এ-ও ঠিক যে দুর্নীতি-ব্যর্থতায় নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানের জন্য এ দৃষ্টান্ত শিক্ষণীয়, অনুকরণীয়। তবে এ দৃষ্টান্ত অন্যদের দেখানো ও শেখানোর জন্য শিক্ষার্থীরা নিজেরা দীর্ঘ মেয়াদে সে দায়িত্ব পালন করতে পারে না; এটা তাদের দায়িত্বও নয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই দক্ষতা-সততা বাড়িয়ে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কাউট-গাইডরা তো সহায়তা দেবেই। গণজাগরণ মঞ্চ বা কোটা সংস্কার আন্দোলনও একটি যৌক্তিক সময়ের পরে, বিশেষত মূল দাবি পূরণের পরে সরকারকে তা বাস্তবায়নের সময় দিয়ে প্রত্যাহার করা হলেই পরবর্তী সময়ে জটিলতা হয়তো এড়ানো যেত। কিন্তু যেভাবেই হোক, অন্যদিকের প্রতিক্রিয়ায়ও বাড়াবাড়ি ও অন্যায্যতা ঘটছে বলে মনে হয়।

পরপর ঘটে যাওয়া এই ন্যায্য জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর নেতৃত্ব বা অধিকার নিজেদের হাতে না থাকায় এবং/বা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক তৈরিতে সক্ষম না হওয়ায় সরকার ও সরকারি দল শেষ পর্যন্ত এদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা, কথিত নেতা এবং সেই সূত্রে সন্দেহভাজন ‘উসকানিদাতা’দের বিরুদ্ধে সরকার যে পথ ধরেছে, তা নির্যাতনমূলক, প্রশ্নসাপেক্ষ এবং শেষ বিচারে সরকারের জন্য হিতে বিপরীত হচ্ছে।

সরকারের মধ্যে অনেক মন্ত্রী-সাংসদ আছেন, যাঁরা মাঠের রাজনীতিতে অভ্যস্ত, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত, গ্রহণযোগ্যতাও ভালো। তাঁদের পক্ষে সহজেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা, দাবি মানার নিশ্চয়তা প্রদান করে এক কাতারে থাকা সম্ভব ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগকে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার, পুলিশের পক্ষপাতমূলক আচরণ—সব মিলিয়ে সরকারের নার্ভাসনেস প্রকাশ পেয়েছে। তাতে একটি সহজ সমাধানযোগ্য আন্দোলন নানা দীর্ঘমেয়াদি বিপরীত ফল দিচ্ছে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমসহ সামাজিক নানা সূচকে ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে গর্ব করার মতো অনেক সাফল্য সত্ত্বেও সরকারকে ক্রমেই অধিকতর দমন-পীড়নমূলক পদক্ষেপে জড়িয়ে জনমতের বিপরীতে যেতে দেখা যাচ্ছে। একটি অরাজনৈতিক ইস্যুর অরাজনৈতিক জনপ্রিয় বিক্ষোভের পরিণতি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য নেতিবাচক হবে কেন?

যেকোনো জনপ্রিয় নাগরিক আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে তার আরেক বিপদ হচ্ছে, সুযোগসন্ধানীরা এতে ঢুকে পড়তে পারে। এতে আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটতে পারে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিপথে, ভিন্ন খাতে চালিত করার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। একইভাবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির অফিসে আক্রমণ হয়েছে কোনো দুরভিসন্ধি থেকেই। দুটি ঘটনাতেই দায়ী ব্যক্তিদের সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বা পুলিশ আজও শনাক্ত করতে পারেনি। সরকারের রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনিক শাখা—দুটিই নিজ নিজ ভূমিকা/দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এর রাগ-ক্ষোভ কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মী এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থকদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, যদিও দুটি ক্ষেত্রেই সরকারের ওপরের মহল থেকে আন্দোলনকারীদের দাবিই মানা হয়েছে। অর্থাৎ তারা যে সঠিক ছিল, তাদের আন্দোলন যে যৌক্তিক ছিল, তারই প্রমাণ মিলেছে। কথা হলো, ন্যায্য, যৌক্তিক
আন্দোলনকে যারা অপব্যবহার করতে চেয়েছে, তাদের ধরার নামে নিরীহ ছাত্র-নাগরিক হয়রানির শিকার হলে তা সরকার ও দলের জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর পুঞ্জীভূত ফল হবে আগামী নির্বাচনকে অবাধ ও হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার মতো সৎ সাহসের ঘাটতি।

তখনকার পরিস্থিতির কথাও মাথায় রাখতে হবে। উৎসাহ ও উত্তেজনা ছিল প্রবল, জনসমর্থন ছিল ব্যাপক, তাতে স্বভাবতই প্রশাসন ছিল শিথিল। এ রকম পরিবেশে হয়তো গুজবের প্রভাবে অনেকেই গা-ভাসিয়েছিল, কিন্তু এ নিয়ে দোষী-নির্দোষ, লঘু-গুরু দোষ-নির্বিচারে একাকার হয়ে ঢালাও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা চলতে থাকলে তার ফলও হিতে বিপরীত হবে।

সরকারের পক্ষে দক্ষতা ও দূরদর্শিতা কীভাবে প্রদর্শিত-প্রমাণিত হবে, তা বুঝতে ভুল করলে কেবলই কঠোর আইন ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকবে। সরকার যে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি, সম্মান ও প্রতিষ্ঠার তোয়াক্কা না করে তাঁকে জেল-রিমান্ডে দিল, তাতে সরকারের শক্তি প্রয়োগের সামর্থ্য বোঝা গেল, কিন্তু প্রজ্ঞার প্রমাণ মিলল কি না, সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। আর তা বোঝার জন্য আইনি নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করলে জোর সম্ভাবনা হলো, সরকারেরই ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে বেশি। তবে আল-জাজিরা টিভি চ্যানেলে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য অনলাইন থেকে যেটুকু শুনতে পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে, তিনি সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ, সরকারের পরিবর্তনও হয়তো চান। এ থেকে তাঁকে বড়জোর সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী বলা যায়। এর বেশি কিছু বলতে চাইলে তা সরকারকে প্রমাণ করতে হবে এবং সেই আইনি নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষার ঝুঁকি নিতে হবে। তা ছাড়া, সরকার আইন নিয়ে জেদ করলে ক্ষুব্ধ জনগণ আইনি প্রশ্নের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ধরবে, আইন যে সব সময় সবার জন্য সমানভাবে চলেনি, তার এন্তার নজির উঠে আসবে তখন।

আমার ধারণা, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল বোঝে, তাদের প্রধান বিবেচ্য হলো জনমত। কোনো ন্যায্য দাবিতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সৃষ্ট ঘটনাপ্রবাহ তো আইনের ব্যত্যয় হয়েই ঘটে। কিন্তু ওই যে জনতার সমর্থন, গণতন্ত্রে তাকে তো মর্যাদা দিতেই হবে। ফলে স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনাপ্রবাহের স্রোতে আরও কিছু অনিয়ম ঘটলে তাকে উপেক্ষা করে দ্রুত নিজেদের জনবান্ধব কার্যকরতার প্রমাণ উপস্থাপনই হলো আগে করণীয়। তাতে পরিস্থিতি বেসামাল হতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনা একইভাবে চলতে থাকবে, মানুষও প্রাণ দিতে থাকবে। হকার ও এলোমেলো পার্কিংয়ে পদযাত্রীদের কষ্ট চলবে আর কেবল আন্দোলনের উসকানির জন্য ডাইনি অন্বেষণ (উইচ হান্টিং) চলতে থাকবে—এসব কি মানুষ সন্তুষ্টচিত্তে নেবে, না সুবিচার ভাববে? মানুষের মনে হবে, পথচারী-যাত্রীর প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে নিজের ‘মান’ বাঁচানোর জন্য মরিয়া সরকার।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ কতভাবে যে সরকার ও রাজনৈতিক দলের বিবেচনায় চলে আসে বা তাদের বিবেচনায় রাখতে হয়, তা বোঝার সামর্থ্য নেই সরকারের, তা আমরা ভাবি না। কিন্তু মুশকিল হলো, সরকারও যেন প্রয়োজনীয় ধৈর্য ধরার ও দূরদর্শিতা দেখানোর মতো সময় না নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনাপ্রবাহে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় ভেসে চলেছে। একটু থেমে পুরো বিষয়টা পূর্বাপর ভাবতে বলব। পরিণত মানুষের জগতে প্রয়োজনে ‘উপেক্ষা’র শক্তি প্রয়োগই শ্রেয়। এ বাণী আমার নয়—এশিয়ার আলো গৌতম বুদ্ধের।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক