কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। আর প্রতিটি দেশের নির্বাহী বিভাগের নেওয়া নীতির ভিত্তিতেই কোটাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। বিশ্বের কোনো দেশে কখনো এটা বিচার বিভাগের নির্দেশনার ভিত্তিতে চলেনি। সুতরাং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যদি সত্যিই মতামত দেন যে বিষয়টি নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে, তাহলে আমরা তাতে বিস্ময়ের কিছু দেখি না।
তবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার সংস্কারে জেগে ওঠা উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এর আগে এ বিষয়ে আদালতের দেওয়া রায়কে বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছিল। যার মূল কথা ছিল, সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা চলমান রয়েছে, তা সংশোধনে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বাঁধা। কারণ, ওই ৩০ শতাংশ কোটা টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এমন ধরনের বক্তব্য সংসদেও উচ্চারিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয় যে এই বিষয়ে বিভিন্ন মামলায় আদালত যা বলেছেন, তা নিতান্তই ‘পর্যবেক্ষণ’। আইনি মত হলো, পর্যবেক্ষণ ঐচ্ছিক, নির্বাহী বিভাগের প্রতি তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়।
অবশ্য আমাদের অনুসন্ধানে এটা পরিষ্কার যে এ বিষয়ে রায় বা পর্যবেক্ষণ যা–ই থাকুক না কেন, তা কোটা সংস্কারে নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ারকে সংকুচিত করে না। কোনোভাবেই আদালতের অবস্থানকে কোনো প্রতিবন্ধকতা বলা আগেও যেত না, এখনো যাবে না। আমরা সে কারণে এই খবরে সন্তুষ্ট যে বিলম্বে হলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অভিমত, যাতে যথার্থই বলা হয়েছে যে বিষয়টি নির্বাহী বিভাগের বিষয়, সেটা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন কোটা সংস্কার কমিটির কাছে গেছে। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, কোটা সংস্কার কমিটি বা সরকারের কোনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের অভিমতের অনুকূলে কোনো মতামত দেয়নি। অবিলম্বে এর একটা ফয়সালা না করা হলে সার্বিক বিচারে এটা নির্বাহী বিভাগের তরফে একধরনের পলায়নপরতা কিংবা কালক্ষেপণের একটি কৌশল হিসেবে দেখা হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। তিনি যে অভিমত দিয়েছেন, তার আলোকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কমিটি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে অনুযায়ী মন্ত্রিসভাকেই পরিবর্তিত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত কোনো প্রকারের রাখঢাক ছাড়াই ঘোষণা করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বাংলাদেশের আগে বিশ্বের বহু দেশ জাতির গর্বিত সন্তান ও তাদের পোষ্যদের জন্য যথাকরণীয় কী কী উপায়ে নিশ্চিত হতে পারে, তার সফল নজির স্থাপন করেছে। সুতরাং বিষয়টি অনুসরণ করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন নয়।
এই বিষয়কে সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং তার প্রতি ক্ষমতাসীন দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মতো কোনো রাজনৈতিক হারজিতের নিরিখে গণ্য করা উচিত নয়। বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জাতি গঠনের বৃহত্তর স্বার্থে দেখতে হবে। বাংলাদেশকে শিক্ষা–দীক্ষা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর মহান ব্রত থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট ভোগ কিংবা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। আজ তঁাদের পোষ্যদের প্রতি রাষ্ট্রকে অবশ্যই যথাদায়িত্ব পালন করতেই হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধা কোটার চেয়ে অন্যান্য কোটার হার বেশি থাকার মতো কোনো নীতি চলমান থাকতে পারে না।
আমরা বিশ্বাস করি, ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা জানেন, দেশের স্বার্থে কোনটি সঠিক পদক্ষেপ। নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে একে না মিলিয়ে কমিটিকে কোটাব্যবস্থা সংস্কারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার সংকেত ও নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।