
সরকারবিরোধী ঐক্য হোক বা না হোক, নির্বাচনের জন্য মাঠ সমতল হোক বা না হোক, একটি বিষয় পরিষ্কার যে কোনো দলই দেশের শাসনব্যবস্থায় কোনো বড় পরিবর্তন আনার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগ থাকবে। গত পাঁচটি সিটি নির্বাচন ছিল অন্তত পাঁচটি সংসদীয় আসনে ভোটাভুটি হওয়া। তাতে অনুমান করা যায়, সুইং ভোটাররা সব থেকে কম ভোটকেন্দ্রে গেছেন। সার্বিকভাবে মানুষের মধ্যে একটা ভোটবিমুখতা এসেছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নের বিচারে ভোটবিমুখতা ভালো লক্ষণ নয়।
১৯৯০ সালের আগে সামরিক শাসন পর্বে মানুষ ভোটবিমুখ ছিল। এরপর ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পরে মানুষ ভোটমুখী হয়। কিন্তু সেটা রাজনীতিকেরা উদ্ভাবনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে এনেছিলেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মানুষ ভোটমুখী হয়েছিল।
সেই সময়ের বিচারে সংকট এখন আরও গভীরতর হয়েছে। কারণ, কেউ স্বীকার করি আর না-ই করি, দোষ যার যত বেশি বা কম হোক, রূঢ় বাস্তবতা হলো কোনো নির্দলীয় পদ্ধতিগত ব্যবস্থা, বড়জোর সাময়িকভাবে কাজ করলেও করতে পারে। কিন্তু তা আর পদ্ধতিগতভাবে দীর্ঘ মেয়াদে একদম কাজ করবে না। বিচার বিভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত করার বিনিময়ে তিনটি নির্বাচন আমরা করেছি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করার পরিণাম হলো পাকিস্তান। তারা পাঁচটি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের আওতায় করতে সক্ষম হলেও সেটা কোনো মডেল, তা কেউ বলবে না। ইমরান খান রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত তথা সংবিধানসম্মত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচিত হলেন, কিন্তু বিশ্ব তাঁকে ভালোভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিতে সন্দিহান। সন্দেহটা হলো জনগণ নয়, বন্দুকের নলই তাঁর ক্ষমতার উৎস। এভাবে জিতে আসা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল কত বড় মৌলিক সংস্কার করতে পারবে, তা–ও বড় প্রশ্ন হয়ে থাকছে। আমাদের অনেকের কাছে অপ্রিয় ঠেকতে পারে, কিন্তু একটা সত্য এই যে আমরা ছি ছি করতে গিয়ে কখন যেন পাকিস্তানি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই অনুসরণ করে বসে থাকি।
পাকিস্তান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না। বাংলাদেশও পারে না। পাকিস্তানের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নকে কখনো বড় করে দেখতে চায়নি। সব সময় অ্যাডহকভিত্তিক থাকতে সচেষ্ট থেকেছে।এই অ্যাডহক ভিত্তিতে চলার নীতি গত ৪৭ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এখন অবস্থা এমন শোচনীয় যে দলীয় বড় পদধারী মানে বড় দায়িত্বশীল, সমাজের সব থেকে শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি নন। তিনি এখন ‘পার্টিজান’ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এই অবস্থা এক দিনে পাল্টাবে না। কিন্তু পথচলাটা তো থামালে চলবে না। কিন্তু সঠিক পথে চলা শুরুর কোনো লক্ষণ নেই। প্রাক্-নির্বাচনী পর্বে যা কিছু চেষ্টাচরিত্র চলছে, তা নির্বাচনী যজ্ঞে কাজে না লাগলে, নির্বাচনের পরে কোনো কাজে লাগবে না।
একটা অদ্ভুত অবস্থা চলছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে মানুষের আস্থাভাজন হওয়া থেকে দূরে সরে গেছে। ধরা যাক, আগামী ডিসেম্বরের আগে কোনো দল বা জোট গণমুখী সংস্কারের একটা ঘোষণা যেন দিয়েই বসল, তারা একটি কাজের তালিকাও দিল। বলল, আমরা নির্বাচনে গিয়ে সরকার করতে পারলে ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব। কিন্তু সে কথায় সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রাখবে কোন দুঃখে? সেটাও কম জোরালো প্রশ্ন নয়।
বাংলাদেশে এখন কোনো সংস্কার আনা আদৌ সম্ভব নয়। সংস্কারের কথা বলা সম্ভব। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যাঁদের এটা বলার কথা, তাঁরা সেটা বলছেন না। কিছু কথা বলাবলি হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা নির্দিষ্ট নয়। তবে সমাজকে তৈরি করা হচ্ছে না। তার প্রমাণ কেউ দল বিনির্মাণে বিশ্বাসী নয়। কেউ ধারণা দিচ্ছেন বটে, সরকার করতে পারলেই তাঁরা তা করে দেখাবেন। কিন্তু সেটা বাস্তবতা নয়। কারণ, জনমত এবং ব্যাপকভিত্তিক বোঝাপড়া সমাজে অনুপস্থিত থাকলে যাঁরা মোবাইল কোর্ট কর্মকর্তাদের হাত থেকে নিয়ে বিচারকদের কাছে দিতে চাইবেন, তাঁরা বিফল হবেন। আমলাতন্ত্র তাঁদের ব্যর্থ করে দেবে।
পাকিস্তানের ২৩ বছরে মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ কী, তা জনসভাগুলোতে যথেষ্ট ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। তারই ফল সংবিধানে লেখা হলো, টেকানো গেল না। এখনো এসবের যা সংবিধানে আছে, তা অনেকটা কথার কথা হয়ে আছে। রাষ্ট্র, সংসদ, আদালত পরিচালনা কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আমরা ধাঁধায় আছি। বুলি ও কাজ এক নয়। তাই মনে হয়, সব থেকে ভালো হয় আমরা যে রাজনৈতিক শূন্যতা এবং একটা ব্যবস্থাপনাগত নাজুক অবস্থার মধ্যে আছি, সেটা অস্বীকার করে নেওয়া। সবাই অস্বীকার করলে সমাধানের একটা পথ বেরোতে পারে।
আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা। কিন্তু এটাও জাতীয় রাজনীতিতে নতুন কোনো উপসর্গ নয়। কমবেশি সব সময় ছিল। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, তখনো রাজনীতিকেরা বড় সংস্কারে হাত দেননি। দুই প্রধান দলের কোনোটিই পরস্পরকে সংস্কার করা বা না-করা নিয়ে অতীতে কখনো দোষারোপ করেনি। এখনো তারা করছে না। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতি এখন পর্যন্ত কেবলই ক্ষমতাসর্বস্ব।
বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, কিংবা সব দলের অংশগ্রহণে সামনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে যাচ্ছে কি না—এ ধরনের প্রশ্নই সব থেকে জ্বলন্ত। কোনো সাধারণ নির্বাচনের আগে এ ধরনের বাস্তবতা বিরাজ করলে স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ থাকে, এবং তখন মৌলিক সংস্কারের প্রশ্ন উপেক্ষিত থাকতে বাধ্য।
তাহলে বিকল্প কী? একটা উত্তর ভাঙাচোরা যা-ই থাক, আমরা পছন্দ করি বা না-ই করি, আপাতত মন্দের ভালো বিকল্প হলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই বাঁচিয়ে রাখা। তাকে দুর্ঘটনায় পড়তে না দেওয়া। এ জন্য দায়িত্বশীলদেরই সব থেকে বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। গণতন্ত্র আছে বলেই আমরা শত সংকোচনের মধ্যেও সরকারের সমালোচনা করতে পারছি। ঈদের আগেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যে জামিন পেল, সে জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ দিই। আমাদেরই বুঝতে হবে, মনের অগোচরে আমরা নির্বাহী বিভাগকেই ধন্যবাদটা দিই এবং তাঁরাও সেটা নেন। এই যে রূঢ় বাস্তবতা, এটা রাতারাতি বদলানো যাবে না। কোনো বিপ্লবী, আধা বিপ্লবী পথে কার্যকরী বড় সংস্কার এ দেশে আসার সময় হয়েছে বলেও মনে হয় না।
দুই বড় দলের বাইরে যাঁরা নিয়ামক শক্তি আছেন, তাঁরাও একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া শাসনগত আর কিছু অত বিস্তারিত ও খোলাখুলি বুঝতে চান না। সুতরাং আসন্ন নির্বাচন যেমনই হোক, দেশকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ধারায় ফেরানোর কাজ দুরূহই থাকছে।
অবশ্য এটাও কি কোনো প্রশ্ন যে সংস্কার না দিতে পারলে অবাধ ভোটও চাওয়া, দেওয়া বা নেওয়া যাবে না? এর উত্তর হলো যাঁরা সুশাসন দিতে পারেন না, তাঁরা অবাধ ভোটও দিতে পারেন না। পারবেন না। সুশাসন রাষ্ট্রের শক্তিময়তার ওপর নির্ভরশীল। অন্যভাবে বললে দল পরিচালনা ও নির্বাচন যত দিন সুশাসন থেকে আলাদা থাকবে, তত দিন সুশাসন ও সুনির্বাচন দুটোই অধরা থাকবে। আর দলে ও দেশে সুশাসনের দাবি সমাজের ভেতর থেকে উঠতে হবে, যেটা উঠছে না। নাগরিক সমাজ রুগ্ণ রাজনীতির স্রোতে মিশে গেছে। দেউলিয়া হওয়ার পরেও এই সত্য তাঁরা মানতে পারছেন না যে বিদেশিদের টাকায় যে চিন্তাশালা (থিংকট্যাংক) ও এনজিও তাঁরা করেছিলেন, তা আর্থসামাজিক উন্নয়ন দিয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের উন্নয়ন দেয়নি।
আসুন, আমরা আমাদের রাজনৈতিক উন্নয়নের মৌলিক দুর্বলতাগুলো স্বীকার ও তা চিহ্নিত করি। জাতির অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্বার্থেই আমাদের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক উন্নয়ন অনিবার্য। এই উন্নয়নের জন্য সমাজ তৈরির কাজে হাত দিতে হবে। যদিও এর গতি হবে মন্থর। নির্বাচন আসছে। এখন দাবি আদায় ও তা নাকচে কোনো ধরনের চরমপন্থা অনুসরণ করলে তা হবে আত্মঘাতী। দীর্ঘ মেয়াদে একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শাসনগত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও তাকে টেকাতে দীর্ঘমেয়াদি বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য পূর্বশর্ত।
মিজানুর রহমান খানপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক