মুসাফির মাশরাফির জেদ ও কষ্ট

মাশরাফিকে মনে হয় এক মুসাফির—যেন কোন সুদূরে তাঁর চোখ।
মাশরাফিকে মনে হয় এক মুসাফির—যেন কোন সুদূরে তাঁর চোখ।

ছোট ভালোবাসা দেয় দুঃখ-ঈর্ষা, বড় ভালোবাসা দেয় শক্তি। মাশরাফির ভালোবাসায় দেখি ইচ্ছাশক্তি, তাঁকে ভালোবেসে জাগে আত্মবিশ্বাস। মাশরাফি ভাবায়। বারবার ভাবায়।

যাকে তার লোকেরা ভালোবাসে, যার বিজয়ে কারও হিংসা হয় না, সেটা কে? সেটা হলো দেশ। কোনো কোনো মানুষও তেমন হয়। যার বিজয়ের ভাগ সবাই অকাতরে নিতে পারে, যার সাফল্যে মনে হয় আমিই জিতলাম। যাঁর উদারতার সামনে ব্যক্তিগত ইগো অবশ হয়ে যায়। মাশরাফি দিনে দিনে এমন ইমেজেই জনমানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

অতি বড় আশাবাদীর পক্ষেও বাংলাদেশের দিনকে এখন সুসময় বলা মানায় না। এটা এমন এক সময়, যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে বাজি ধরাও কঠিন। এটা সেই সময়, যখন সুবাতাসের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে। কোনো দেশ যখন রাজনৈতিক কারণে ভীত ও দিশাহীন বোধ করে, তখন তারা উঠে দাঁড়ানোর কোনো নজির দেখতে চায়। মন্দ বাস্তবতার বাইরের কোনো প্রতীকের ওপর ভর করে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য ফিরে পেতে চায়। ক্রিকেট সে রকমই এক জাতীয় প্রতীক হয়ে আছে। ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মুর্তজা তার নায়ক। পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি দাঁড়ানোর নেতাও তিনি।

কিন্তু গুড়ের মধ্যে বালি যেমন কিচকিচ করে দাঁতে লাগে, তেমনি ক্রিকেটীয় বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা দেখে অস্বস্তি হয়। ক্রিকেটের আবেগের পালে বাতাস দেয় জাতীয়বাদী ঘৃণা। রাষ্ট্র-রাজনীতিতে যে জাতীয়তাবাদ প্রায় বিলুপ্ত, দেশপ্রেমের দায় মুছে ফেলছেন যখন অনেকেই, তখন ক্রিকেটই হয়েছে সেই মেকি জাতীয়বাদের শেষ আশ্রয়। খেলার মাঠে পাকিস্তান-ভারত বা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে জাতীয়তাবাদী জোশে তাদের বদনামে ডাকি, তখন জাতীয়তাবাদকে মনে হয় প্রতিহিংসার জ্বালানি। বাস্তবে ‘আমরা’ বা ‘তারা’ নিছকই দায়িত্বশীল খেলোয়াড় ও আনন্দভুক দর্শক। মুশফিকের সঙ্গে পাকিস্তানের জুনায়েদের বা মাশরাফির সঙ্গে ভারতীয় ক্যাপ্টেন ধোনির কোনো শত্রুতা নেই। বরং দেখা যায়, ভালো খেলোয়াড়েরা একে অন্যকে পছন্দ করেন, পরস্পরের কাছ থেকে শেখেন। কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে মাতোয়ারা জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের নায়ককে বানান বীর আর প্রতিদ্বন্দ্বী বীরকে ভাবেন খলনায়ক। অথচ যার যার দেশবাসীর কাছে উভয়ই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র।

যে জাতি নিজের জয়কে স্থায়ী করতে না পারার দুঃখে দুঃখী, যাদের আত্মবিশ্বাস থার্মোমিটারের পারদের মতো ওঠানামা করে, ক্রিকেটীয় জাতীয়তাবাদ তাদের জন্য টনিক, অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ঢাকার লালসালু। এটা অনেকটা ভিখারির ঘায়ের মতো, চুলকিয়েও আরাম আবার দেখিয়ে ভিক্ষাও মেলে। কিন্তু সাবালক জাতি ঘা পুষে রাখবে না। ঘা সারিয়ে সুস্থতাকেই প্রদর্শন করবে।

ছোট জাতীয়তাবাদের নজরটা ছোট, বড় জাতীয়তাবাদের নজর খানিকটা বড়। কিন্তু দুটোই অহংকারী, দুটোই ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ হিসেবে মানুষকে ভাগ করে ফেলে। বাঙালির জাতীয়তাবাদে বাংলাদেশের বাঙালি আছে, পশ্চিম বাংলা-আসাম-ত্রিপুরার বাঙালি নেই। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চোখে বিদেশিরা খারাপ। বাঙালি বা বাংলাদেশি কোনো জাতীয়তাবাদী পরিচয়ই দেশের সব মানুষকে সমান মর্যাদায় বুকে নিতে আজও পারেনি। ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদও প্রায়ই স্বধর্মীদেরও ভয় দেখায় আবার পা পিছলে সাম্প্রদায়িকতার গর্তে পড়তে তার দেরি হয় না। ভারত এত বড় দেশ, কিন্তু সেখানে কে ভালো ভারতীয় কে না, কে দেশদ্রোহী কে বিদেশি কে ভিন ধর্মের, তা নিয়ে খুনোখুনির পর্যন্ত চলছে।

জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেম এক না। জাতীয়তাবাদ তখনই কার্যকরী, যখন দেশ আক্রান্ত হয়, যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১–এ। কিন্তু দেশপ্রেম শান্তি ও যুদ্ধ সব সময়ই জরুরি। জাতীয়তাবাদের কথা হচ্ছে, ‘ওরা খারাপ আমরা শ্রেষ্ঠ’। দেশপ্রেমের লক্ষ্য অন্যরা নয়, নিজেরা। দেশ ও দেশের দেশিকে ভালোবাসাই দেশপ্রেম, আর অন্য জাতিকে ঘৃণা করা ছাড়া জাতীয়তাবাদী কথাই বলতে পারে না। জাতীয়তাবাদ যুদ্ধ চায়, বীর চায়, কঠোর নেতা চায়। যুদ্ধ জিতলেও বীর পেলেও কঠোর নেতার শাসনে শেষ পর্যন্ত দম হাঁসফাঁস করে তাদের। দেশপ্রেম চায় সকলেই দেশের জন্য নিজের সেরাটা করুক, সকলে সকলকে নিয়ে ভালো থাকুক।

ইংরেজ ভাবুক স্যামুয়েল জনসনের (১৭০৯–১৭৮৪) একটা উক্তির খুবই প্রচার ও পসার। ১৮ শতকের ইংল্যান্ডে উনি বলেছিলেন, ‘দেশপ্রেম বদমাশের শেষ আশ্রয়।’ সেই থেকে অনেক বিজ্ঞ মানুষও দেশপ্রেমের নিন্দা করেন। অথচ ওই জনসন সাহেবই তাঁর রচিত অভিধানে দেশপ্রেমের সংজ্ঞায় বলছেন, দেশপ্রেমিক তাকেই বলে, দেশের প্রতি ভালোবাসাই যার হৃদয়কে চালিত করে। তাঁর কথায়, একজন দেশপ্রেমিকের সব কাজের মূলে থাকে একটাই চিন্তা, দেশের প্রতি ভালোবাসা। সাংসদ হিসেবে ভয় বা আশায়, দয়া বা অসন্তোষের বশে তিনি কিছু করেন না, যা-ই করেন জনস্বার্থের কথা ভেবে করেন।’

এটা স্যামুয়েল জনসনের সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞার মধ্যে মাশরাফিকে বসিয়ে দেখলে কী পাই? একজন দেশপ্রেমিককে পাই, যিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে ভয় বা আশায়, দয়া বা অসন্তোষের বশে কিছু করার লোক না। যা-ই করেন দেশপ্রেমের বশেই করেন।

স্যামুয়েল জনসন বদমাশদের দেশপ্রেমিক সাজাকে খোঁটা দিয়েছিলেন, দেশপ্রেম জিনিসটাকে না। দেশপ্রেম হলো বদমায়েশির বিপরীত ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ ডাক। তা ছাড়া, ঔপনিবেশিক আমলে বিদেশি প্রভুরা আর এখন স্বদেশি দেশচ্যুতরা নিজেদের স্বার্থে দেশপ্রেমকে তুচ্ছ করে যে কথাটা ব্যবহার করে, সেটা মাশরাফির মতো একজন পরীক্ষিত দেশপ্রেমিকের বেলায় খাটে না। দেশপ্রেম কত সুস্থ, সুন্দর ও শক্তিদায়ী হতে পারে, মাশরাফির মতো মানুষ তার প্রমাণ। তিনি একা নন, তাঁর আমাদের ক্রিকেটাররা আছেন, আছেন অনেক উজ্জীবিত তরুণ। শুধু পেশাদারি দক্ষতা দিয়ে মাশরাফিকে মাপা যায় না।

রাজনীতিবিজ্ঞানের তুমুল সাড়া জাগানো বই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ইমাজিনড কমিউনিটি। তিনি বলছেন, কারও পক্ষেই সমগ্র জাতিকে চিনবার বা জানবার সুযোগ হয় না। জাতি, জাতীয়তার ধারণা তাদের কল্পনা করে নিতে হয়। এই প্রতীকগুলোকে পরিচিত করানোয়, দেশের ধারণা সব নাগরিকের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার কাজ করে গণমাধ্যম, যোগাযোগব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তক।জাতীয়তাবাদ জাতিকে তরুণের আদলে কল্পনা করে ও করায়। সেই কল্পনা আশ্রয় করে অতীতের বীর সংগ্রামী কিংবা শহীদ নায়কের ওপর। এন্ডারসনের কাছে অ-ইউরোপীয় জাতিগুলো কল্পনা, মিডিয়া ও বাজারের সৃষ্টি মনে হওয়া স্বাভাবিক। ইউরোপ নিজের ধর্ম, জাতীয়তা ও সংস্কৃতিকে আসল আর তাদের দখলে থাকা দেশগুলোর ধর্ম-জাতীয়তা ও সংস্কৃতিকে কাল্পনিক ও অনুকরণজাত ভাববে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে দেশের মানুষ বহুকাল পরাধীন ছিল, যে দেশের সংগ্রাম করে যায়, যে দেশ আর তুচ্ছ হতে রাজি না, তাদের মিলনবাদী জাতীয়তাবাদ আর উদার দেশপ্রেমের দরকার হবে। দরকার হয় বলেই, আমরা আমাদের উদ্বুদ্ধুকারী নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে গৌরব করবই। এতে কারও কোনো ক্ষতি নেই।

ক্রিকেটীয় আত্মবিশ্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর বিচ্ছিন্ন মনগুলোকে জোড়া লাগিয়ে আত্মমর্যাদাবান করে তুলেছিল। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়েরা প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল তাদের ক্রিকেট দল। বাংলাদেশেরও এখন এ রকম ঐক্যসূত্রের দরকার আছে। নিপীড়িত দেশের মানুষের জন্য দেশপ্রেম এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক, যদি তা অহংকারী না হয়ে গ্রহণবাদী হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা, বিনয় সামর্থ্যবানের পরিচয়।

আমির খানের জনপ্রিয় ‘লগান’ সিনেমাও কোনো বানানো গল্প না। এই সুখকর অঘটন ঘটিয়েছিল ঢাকার তরুণেরা। ১৮৮০-এর দশকে পূর্ব বাংলার তরুণেরা প্রথম পেশাদার ক্রিকেট দল গঠন করে ইংরেজ টিমকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হারিয়েছিল। বাংলা সিনেমার নায়কের মাথায় যেমন বাড়ি না পড়লে হারানো স্মৃতি মনে পড়ে না, তেমনি ধাক্কা খেয়েই আমাদেরও মনে পড়েছে: পূর্ব বাংলার এক মফস্বলী যুবক ছিলেন ভারতবর্ষীয় ক্রিকেটের জনক! উপমহাদেশে ক্রিকেট ও জাতীয়তাবাদের রাখিবন্ধন ঘটিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের জমিদারপুত্র সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী—সত্যজিৎ রায়ের প্রপিতামহ, সুকুমার রায়ের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই। সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের পরাজয়ের অন্ধকারে ভারতবাসী মুষড়ে পড়েছিল। গায়ের বল তো চূর্ণই, মনের বলও তলানিতে। সে সময় সারদারঞ্জন কিশোরগঞ্জ থেকে পড়তে এসে ভাইদের নিয়ে বানিয়ে ফেললেন ঢাকা কলেজকেন্দ্রিক ঢাকা ক্রিকেট ক্লাব। তাঁর দল বেশ কয়েকবার ব্রিটিশদের হারিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের পর প্রথম খেলার মাঠেই নতুন বাঙালি মধ্যবিত্ত জাতীয় ঐক্য অনুভব করতে পেরেছিল। একে আধুনিক জাতীয়তাবাদের অসচেতন সূচনাও বলা যায়।

মানুষ যখন আশা হারায়, তখন কোনো তত্ত্ব, কোনো পরিসংখ্যান, কোনো আশ্বাস তাকে আশাবাদী করে না। তারা তখন চায় তাদেরই মতো রক্তমাংসের কারও মহৎ দৃষ্টান্ত। হাঁটুতে ১৭টি সার্জারি নিয়েও সংশপ্তকের মতো লড়ে যাওয়া, অলিম্পিক অ্যাথলেটের মতো উড়াল দিয়ে বাঁ হাতে ধরা ক্যাচ, দলের সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়াই জয়ী হওয়া আমাদের জানায় অদম্য জেদ আর দেশপ্রেমের কথা। মাশরাফির নজির সংক্রামক। মুশফিক পাঁজরের হাড়ে চিড় নিয়ে অসাধারণ দুটি ইনিংস খেলে দলকে জেতালেন। তামিম মচকানো হাত গলায় ঝুলিয়ে ব্যাট হাতে বিজয়ের সহযাত্রী থাকেন আর মাহমুদউল্লাহ–মোস্তাফিজদের মতো খেলোয়াড়দের ভেতর থেকে যখন যে সেরা অবদান দরকার, সেটা বের করে আনেন। আমাদের অসামান্য খেলোয়াড় আছে, কিন্তু সব শক্তি এক করার নেতৃত্বটা মাশরাফিরই। হয়তো একদিন আমরা আরও পেশাদার হব, মাশরাফির মতো খোঁড়ানো জেদ আর প্রচণ্ড মনোবল দরকার হবে না। কিন্তু আজ আমাদের যা ঘাটতি, তা পূরণে মাশরাফির মতো মানুষ অনিবার্য।

বাংলাদেশের যদি কোনো জাতীয় বৈশিষ্ট্য থাকে, এসবের মধ্যে তার ভালো দিকের ছাপ দেখি। বয়স যা–ই হোক, বাংলাদেশিরা স্বভাবে আমুদে, জেদি আর আবেগপ্রবণ। শক্তিমান কারও ত্যাগ দেখলে এই মানুষেরা নিজেদেরও উজাড় করে দিতে পারে। মাশরাফির মতো ক্ষতবিক্ষত কিন্তু অনড় শালগাছ নবীনদের জাগিয়ে তোলে। তা থেকে আমরা যাতে শিখি।

একটা পাঞ্জাবি গল্প। পাঞ্জাবে তখন হিংসা ও হতাশা। যুবকেরা সশস্ত্র আন্দোলনে মারা পড়ছে। এমন দিনে এক মুসাফির এলেন গ্রামে। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে তাঁকে অনেক দূর থেকে আসতে দেখা গেল। মাঠে কাজ করছিলেন এক গরিব কৃষক; তিনি তাঁর পিপাসা মেটালেন, রাতে বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। রাতে যৎসামান্য আহারের পর গল্প হলো। কৃষক পরিবারটি একা, একমাত্র সন্তান আন্দোলনে নিহত বা নিখোঁজ। গ্রামে পুলিশের চর ঘোরে, সশস্ত্রবাদীদেরও আনাগোনা। ভয় নিয়েও বুড়া-বুড়ি মুসাফিরকে শুতে দিলেন বারান্দায়। সকালে মুসাফির বিদায় নেবেন। আশ্রয়দাতা কৃষক কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি খেয়াল করেছেন, সেই দুপুরে যখন তাঁরা দুজন জমির আইলে বসে বউয়ের পাঠানো ছাতু খাচ্ছিলেন, তখনো যেমন এখনো তেমন, মুসাফির লোকটা তাঁর কাপড়ের পুঁটলিটা একদম হাতছাড়া করছেন না। ঘুমালেনও সেই তালি মারা পুঁটলিটায় মাথা রেখে।

সন্তানহারা বৃদ্ধ কৃষক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার এই পুঁটলিটাকে নিয়ে এত ভয়, এতে কী আছে?’ মুসাফির মানুষটি তখন নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি ভগবান। কিন্তু মানুষ আজ আর তাঁর পথে নেই। মানুষ হিংসা-লোভে দুনিয়াকে নরক বানিয়ে ফেলেছে। ভগবানেরও নিজের কাছে আর কিছু নেই। এই পুঁটলিটাই তাঁর সম্বল। এখানে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন আশা, ভালোবাসা আর মানবতার সামান্য অবশেষ। আবার যদি মানুষের কখনো এসবের প্রয়োজন পড়ে, তাই তিনি জগতের সেরা গুণগুলো আগলে রাখছেন।

বৃদ্ধ কৃষক থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুসাফির ধুলোর পথে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল!

মাশরাফিকে ঠিক গড়পড়তা বাংলাদেশি লাগে না। এ রকম শিলার মতো ইচ্ছাশক্তি, বড় মন আর কোমল দেশপ্রেম এ যুগে খুব বিরল। বড় ভালোবাসার কষ্ট বেশি। মাশরাফিকেও তাই মনে হয় এক মুসাফির—যেন কোন সুদূরে তাঁর চোখ। মনে হয় আমাদের হারানো দেশপ্রেম এই যুবকের বুকের মধ্যে খুব যত্নে, খুব কষ্টে গচ্ছিত আছে, রক্ষিত আছে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]