জয়ের নায়কেরা বনাম...

সাফ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশেরা কিশোরী মেয়েরা
সাফ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশেরা কিশোরী মেয়েরা

২৭ সেপ্টেম্বর আমাদের একজন প্রধান সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের ক্রমাগত প্রেরণা দিয়ে যান, তাঁর নূরলদীন আমাদের ডাক দিয়ে যায়, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়।’ আমি কয়েকবারই তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের ইতিহাসকে দুই-চার বছরের নিরিখে মাপতে হয় না। মহাকালের বিচারে দুই-চার বছর কিছুই নয়। সামগ্রিক বিচারে মানুষের ইতিহাস হলো অগ্রযাত্রার ইতিহাস।’

আমাদের গতকালের দিনটা অবশ্য শুরু হয়েছে সুখবর দিয়ে। এশিয়া কাপের অলিখিত সেমিফাইনালে বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানকে। আজ ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। তারও আগে, গত জুন মাসে, আমাদের নারী ক্রিকেটাররা ভারতকে হারিয়ে টি-টোয়েন্টিতে এশিয়া কাপ জিতে নেয়। আমাদের নারী ফুটবলাররাও জয়ের খবর এনে দিচ্ছে একের পর এক। অনূর্ধ্ব–১৬ এএফসি কাপে দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, আর কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশই যা পারেনি। কিশোরী ফুটবলাররা গত তিন বছরে অনেকগুলো কাপ এনে দিয়েছে আমাদেরকে। এটা সম্ভব হয়েছে নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। তাদেরকে ঢাকায় ক্যাম্পে রাখা হয়, তারা একসঙ্গে থাকে, একসঙ্গে খেলে, প্রশিক্ষকের নেতৃত্বে নিয়মিত অনুশীলন করে।

লক্ষ্য ঠিক রেখে যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং পরিশ্রম যে সফলতা এনে দিতে পারে, আমাদের কিশোরী ফুটবলাররা তার প্রমাণ। এ জন্য তাদের প্রশিক্ষক গোলাম রাব্বানী ছোটন এবং ফুটবল ফেডারেশনের নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণসহ সংশ্লিষ্টরা আমাদের ধন্যবাদ পাবেন।

একবার ঈদের আগে রোজার সময়ে গণভবনে দেখা হয়েছিল এই কিশোরী ফুটবলার আর তাদের প্রশিক্ষকদের সঙ্গে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঈদে এরা বাড়ি যাবে না? উত্তর পেয়েছিলাম, এরা বাড়ি গেলেই ফিটনেস নষ্ট করে আসবে। আমি বললাম, কেন, বাবা-মা আদর করে বেশি বেশি খাইয়ে এদের ওজন বাড়িয়ে ফেলবে? উত্তর এসেছিল, ‘উল্টোটা। কম খেয়ে এরা স্বাস্থ্য নষ্ট করে আসবে।’

আপনারা জানেন যে এই কিশোরী ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড়, সেদিনও ভিয়েতনামকে গোল দিয়েছে যে তহুরা, কিংবা মারিয়া; তারা এসেছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম থেকে। প্রথম আলো এই কিশোরী ফুটবলারদের অনেককেই সামান্য বৃত্তি দেয়, প্রথম আলো তাদের নিয়ে প্রামাণ্য ছবিও বানিয়েছে—অদম্য মেয়েরা। ফুটবলার মেয়েদের চাওয়ার কারণে কলসিন্দুর গ্রামে বিদ্যুৎ দিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ–সংযোগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সহযাত্রী হয়ে ওই গ্রামে গিয়েছিলাম আমিও। মারিয়ার মা এনতা মান্দার সঙ্গেও দেখা হয়েছে।

এ বছরের মে মাসে বিশ্ব মা দিবসের প্রাক্কালে প্রথম আলোয় মারিয়া লিখেছিল:

বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে মা এনতা মান্দার লড়াইটা শুরু। আমাদের নিয়ে এখনো লড়ে যাচ্ছেন মা।

ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমাকে ফুটবলার বানানোর পেছনে বড় অবদান মায়ের। যখন কলসিন্দুর স্কুলে মফিজ স্যারের কাছে আমরা ফুটবলের অনুশীলন করতাম, গ্রামের অন্যরা নানা সমালোচনা করত। অনেক বাবা-মা পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মেয়েদের খেলতে পাঠাতে চাইতেন না। কিন্তু আমার মা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কখনো যদি অনুশীলনে যেতে দেরি হতো, বকাবকি শুরু করে দিতেন মা।

আমার মা অন্যের জমিতে কাজ করেন। ধানের মৌসুমে ধান লাগান, মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করেন। এ জন্য দিনে দুই শ টাকা পারিশ্রমিক পান। শত অভাবেও আমার কোনো চাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখেননি। আমার এখনো মনে পড়ে, ছোটবেলায় বুট কিনতে চাইলে চাল বিক্রি করে সেটা কিনে আনতেন মা।

এই কিশোরী মারিয়ারাই তো আমাদের বিজয় এনে দিচ্ছে।  

আমরা অনেকেই এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলা দেখেছি, দেখেছি কেমন করে শেষ বলে তারা হারাল আফগানিস্তানকে, কেমন করে তারা হারাল পাকিস্তানকে। আপনারা কি মেহেদী হাসান মিরাজের শরীরী ভাষা খেয়াল করেছেন। যখন বল করছেন, যখন ফিল্ডিং করছেন, ওঁর চোয়াল কেমন দৃঢ়; ওঁর শিরদাঁড়া কেমন শক্ত, ওঁর চোখে কেমন জিগীষার আগুন! খুলনার কোন পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি! এসবই তো আমাদের ‘অদম্য মেধাবী’র গল্প! যেমন সাতক্ষীরার গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন মোস্তাফিজ।

বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, তা এই মেহেদী, মোস্তাফিজ, মারিয়া, সালমা, তহুরাদের জন্যই। দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব নীরবে সংঘটিত হয়ে গেছে। এক, প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া। এই স্কুলে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটা আরেকটা প্রশ্ন; কিন্তু স্কুলে যাওয়া মানেই একটা মানুষের ভেতরের সম্ভাবনায় পরশপাথর ছুঁয়ে দেওয়া। ওরা স্কুলে গিয়েছিল বলেই আমরা মারিয়াদের পাই, তহুরাদের পাই। মোস্তাফিজদের পাই, মেহেদীদের পাই। সঙ্গে আরেকটা জাদুর কাঠির ছোঁয়া আছে। তা হলো মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট। কলসিন্দুর গ্রামের কিশোরী ফুটবলার তহুরা ফেসবুকে আমাকে লিখেছে, স্যার, দোয়া করেন, ‘আজকে ভুটানে যামু।’ একেবারে এই ভাষাতেই সে লিখেছে।

বাংলাদেশের সমাজের নীরব বিপ্লবের আরেকটা ক্ষেত্র হলো মেয়েদের এগিয়ে আসা। আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মেয়েরা সমানে সমান অংশ নিচ্ছে। সম্ভবত গার্মেন্টসের মেয়েরা এই বিপ্লবের অগ্রসেনা। কৃষিতে কিংবা শিল্পে আজ নারী ও পুরুষ কাজ করছে সমানতালে। আমাদের সাধারণ মানুষেরা গ্রামে–গঞ্জে–শহরে–বন্দরে এইভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদের আয়-উন্নতির চেষ্টা করছে। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকেরা কষ্ট করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

আর, আমরা মেগা প্রজেক্ট করছি। বৃহৎ প্রকল্প। এবং আমাদের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বড় প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু কবে শেষ হবে, জানি না। মেট্রোরেল নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে না। আমাদের দেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের খরচ সারা পৃথিবীর মধ্যে বেশি। ভারতের চেয়ে এই ব্যয় প্রায় ৫ গুণ বেশি। লোকে প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে কি সোনা দিয়ে রাস্তা বানানো হয়?

এবং আমরা আরেকটা রেকর্ড তো করেছি। আমরা বড়লোক উৎপাদনে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ হয়েছি, চীনকেও ছাড়িয়ে গেছি।

এর সবই একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কযুক্ত।

আমাদের মানুষেরা পরিশ্রম করে, আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, আমাদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট গেছে কোটি কোটি মানুষের কাছে; আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ যাচ্ছে; আমাদের মানুষেরা অভিবাসী হয়ে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে; আমাদের প্রবৃদ্ধি হার বাড়ছে। আবার আমরাই মেগা প্রকল্পে উৎসাহ দেখাচ্ছি বেশি, প্রকল্প সম্পন্ন করার যোগ্যতা–দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি; বছর শেষে বরাদ্দকৃত টাকা অব্যয়িত থাকে, অর্থমন্ত্রী এই বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। আমরা বড়লোক উৎপাদন করছি; বিদেশে টাকা পাচারেও শীর্ষ তালিকায় নাম লেখাচ্ছি।

কারওয়ান বাজারে আমাদের অফিসের পাশে পার্ক করে রাখা বাসের নিচে শুয়ে ঘুমান কয়েকজন নারী। তাঁদের দুটো শিশু বাসের পাশে বসে থাকে, গোসল সেরে গামছা পেঁচিয়ে রাখে ছোট্ট শরীরে। পাশেই পার্ক করা গাড়িগুলোর দিকে তাকাই, মার্সিডিজ, পোরশে। কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ির পাশে এই মানবশিশুরা খেলা করে। এত বৈষম্য, এত বৈষম্য!

রেনেসাঁর গান ভাঁজি—আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই, ...রেললাইনের পাশে নয়, অন্ধকার সিঁড়িতেও নয়, প্রতিটি শিশু মানুষ হোক আলোর ঝরনাধারায়।

আমাদের উন্নয়ন হোক এই শিশুকে, প্রতিটা শিশুকে মানুষের জীবন দেওয়ার উন্নয়ন; বড়লোককে আরও বড়লোক করার উন্নয়ন নয়। সুশাসন ছাড়া তা আমরা পাব কী করে?

সৈয়দ শামসুল হক নূরলদীনের সারা জীবন কাব্যনাট্যটি শেষ করেছেন এভাবে—

‘ধৈর্য সবে—ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন।

লাগে না লাগুক, বাহে, এক দুই তিন কিংবা কয়েক জীবন।’

আনিসুল হক, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক