স্থল ও নৌবন্দরের দুর্নীতি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় বাগেরহাটের মোংলা সমুদ্রবন্দর ও লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। টিআইবির গবেষণায় অন্যান্য দুর্নীতির সঙ্গে বুড়িমারী স্থলবন্দরে পণ্য পরিবহনের জন্য প্রতিটি ট্রাক থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ ট্রাকচালক ইউনিয়নের চাঁদার নামে হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য এসেছে।

বন্দর খাতে যে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে, এটি তার খণ্ডচিত্র মাত্র। প্রতিটি বন্দরই বলা যায় দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। দেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলে আমদানি পণ্য খালাসে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রতিবাদে ভারতের ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন বলে মঙ্গলবারের পত্রিকায় খবর এসেছে। বেনাপোলের চারটি জায়গায় প্রতিটি ট্রাক থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা বকশিশ দিতে হয়। এ নিয়ে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈঠক হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বিষয়টি দেশের জন্যও লজ্জাজনক।

টিআইবির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পণ্য আমদানি-রপ্তানি কাজে মোংলা স্থলবন্দরের কাস্টম হাউস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকা ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে’ আদায় করছে। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, মোংলা বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করেছে। এটি আনন্দের খবর হলেও বন্দরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালাল চক্রের অত্যাচারে ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। টিআইবি মোংলা সামুদ্রিক বন্দর ও বুড়িমারী নৌবন্দর সম্পর্কে ঘুষ ছাড়া সেবা মেলে না বলে যে মন্তব্য করেছে, তা বাংলাদেশের সব বন্দর তথা সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।

ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ একে ‘স্পিড মানি’ বলে সাফাই গাইছেন এবং সংশ্লিষ্টদের অপরাধকে লঘু করে দেখছেন।  তাঁদের এ ধরনের কথাবার্তায় দুর্নীতিবাজেরাই উৎসাহিত হয়। উন্নত দেশগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্পিড মানি চালু আছে। কিন্তু সেখানে জবরদস্তির কোনো বিষয় নেই। বাংলাদেশের সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে বাড়তি অর্থ আদায় করা হয়।

কয়েক বছর আগে একটি দেয়াললিখন চোখে পড়ত, যাতে লেখা থাকত ‘ফাইল আটকিয়ে ঘুষ খাওয়া আর বন্দুক ঠেকিয়ে ছিনতাই করা’ একই অপরাধ। এখন আর ঘুষ-দুর্নীতি ফাইল আটকানোর মধ্যে সীমিত নেই। ট্রাক আটকিয়ে তাদের কাছ থেকে  ঘুষ নেওয়া হয়। এটি বেআইনি হলেও ব্যবসায়ীরা দ্রুত পণ্য খালাসের জন্য মেনে নেন। কিন্তু ঘুষ ও চাঁদাবাজির মাত্রা যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তাঁরা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হন।

এর আগেও বিভিন্ন বন্দরের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। ধর্মঘট হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অনেক অসাধু কর্মকর্তা হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ খুবই কম। এর প্রধান কারণ সেখানে দুর্নীতি-অনিয়ম হয় অনেকটা ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে’। ঘুষ-চাঁদার ভাগ যায় ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে। এই অশুভ চক্র ভাঙতে না পারলে সেবা খাতের দুর্নীতি বন্ধ দূরের কথা, কমানোও যাবে না।

বন্দরে দুর্নীতি প্রতিরোধে টিআইবি পণ্যের শুল্কায়ন, কায়িক পরীক্ষণ, পণ্য-ছাড় এবং জাহাজের আগমন-বহির্গমন প্রক্রিয়া অনুমোদনে কার্যকর ওয়ানস্টপ সার্ভিস প্রদান নিশ্চিত করা, সব পর্যায়ে অটোমেশন ও পেপার-লেস অফিস প্রতিষ্ঠার যে সুপারিশ করেছে, কর্তৃপক্ষের উচিত তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। যে  স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে আমদানি-রপ্তানির ৮০ শতাংশ পণ্য আদান–প্রদান হয়, সেই বন্দর এক দিন বন্ধ থাকলে ব্যবসায়ীরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হন না, দেশের অর্থনীতির চাকাও মন্থর হয়ে পড়ে।

যেখানে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় উদ্‌গ্রীব, সেখানে বন্দর ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?