রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর

>

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহযোগিতায় ‘রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো। 

আলোচনায় সুপারিশ

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করতে হবে

শিশুদের মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা প্রয়োজন

রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারের ভেতরে ও দেশে–বিদেশে জনমত গঠন করতে হবে

মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করতে হবে

স্থানীয় জনগণের সাহায্যের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, পরিবেশ ও কর্মের নিশ্চয়তা প্রদান করা প্রয়োজন

প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মনে রেখে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ জরা জরুরি

বিভিন্ন সংগঠনের কাজের সমন্বয় ঘটাতে হবে 

যাঁরা অংশ নিলেন

রাশেদ খান মেনন: মাননীয় সাংসদ, মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

মো. নিজামুল হক: বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত), অ্যাপিলেট ডিভিশন, সুপ্রিম কোর্ট

সত্যব্রত সাহা: অতিরিক্ত সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

আমেনা মহসীন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এম হুমায়ুন কবির: সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত

মো. সাজ্জাদুল ইসলাম: উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ফোকাল পয়েন্ট অফিসার, রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম

জন জ্যাক সিমন: কমিউনিকেশনস চিফ,        ইউনিসেফ

নাজমুল আযম খান: পরিচালক, ডিজাস্টার রেসপন্স ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

আসিফ মুনীর: অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ

রিফাত বিন সাত্তার: পরিচালক, প্রোগ্রাম          ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ

বরকত উল্লাহ মারুফ: সহকারী পরিচালক, রিসার্চ অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া, কোস্ট ট্রাস্ট

গওহার নঈম ওয়ারা: উপদেষ্টা, প্রথম আলো 

সঞ্চালনায়
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো 

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রবেশের পর এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধান প্রয়োজন।

তাদের নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের চিন্তাভাবনা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমান পরিস্থিতি, সমস্যা সমাধানে অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা আলোচনা করবেন।

এখন এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে অনুরোধ করছি। 

রাশেদ খান মেনন
প্রথম দিকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের পর সেখানকার মানুষের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। খাবারের জন্য মানুষের আহাজারি ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য পাঠায়।

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। হাসপাতাল ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বিষয়টি গোটা বিশ্বে আলোচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা এসেছে। পৃথিবীব্যাপী সমর্থন ও সাহায্য বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থায়ী ও সুষ্ঠু সমাধানের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক খেলায় পড়ে গেছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একইভাবে ক্ষমতাধর দেশগুলোর বিপরীতে বাংলাদেশকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।

রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশ সরকার প্রথমত মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত, এ সমস্যা আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘে ৫ দফা দাবি তোলা হয়েছে। এবারও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপন করবেন।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের প্রাক্কালে মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংকট কাটিয়ে উঠেছে। তবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদাসীনতা প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করছে না। উল্টো বাংলাদেশকে দোষারোপ করছে। বাংলাদেশ নাকি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চায় না।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর আমরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বনাঞ্চল ও পাহাড় ধ্বংস হয়েছে। পরিবেশ দূষিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে স্থানীয় জনগণ। দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাহীনতা।

 এ সমস্যার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমরা আর কত অপেক্ষা করব? বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর ব্যয়ভার বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর নীরব ভূমিকা আমাদের হতাশ করছে। 

জন জ্যাক সিমন
শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা গোটা বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৪ লাখ শিশু সমস্যাগ্রস্ত রয়েছে। তাদের নিয়ে আমাদের কী করা উচিত? এক বছর হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে কী ধরনের পরিবেশ বিরাজ করছে? এসব নিয়ে কাজ করতে হবে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সফলতা অর্জন করেছি। ৯৫ হাজার শিশু শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয়েছে। ৩ লাখ লোকের বিশুদ্ধ পানি পানের সুযোগ হয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের সফলতার কথা বলতে পারি। এগুলো স্বল্পমেয়াদি সমাধান। সবচেয়ে উত্তম সমাধান হবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। সুষ্ঠু সমাধানে প্রত্যাবাসনের কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা উচিত।

রোহিঙ্গাদের জন্য একটি স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে জোর দিতে হবে। ইউনিসেফসহ মানবাধিকারকেন্দ্রিক অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। শরণার্থীদের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। ক্যাম্পে পর্যাপ্ত খাদ্য, আবাসন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায় ও সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করা জরুরি। এ ছাড়া শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ প্রদান এবং বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের নিবন্ধন করতে হবে। রোহিঙ্গা কিশোরীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এসব কর্মসূচি পালন করার জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহযোগিতা। 

সত্যব্রত সাহা
রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক বিকাশে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা প্রদান করায় ইউনিসেফ প্রশংসার দাবি রাখে। রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকার প্রথম দিকে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছিল।

রোহিঙ্গাদের প্রবেশের বিষয়টি নিয়ে প্রথম দিকে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছিল। কেন তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে; কেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না ইত্যাদি।

তবে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন সিদ্ধান্তটি যথার্থ ছিল। একটি জাতি অন্য একটি জনগোষ্ঠীকে বিপদে ফেলে রাখতে পারে না। রোহিঙ্গাদের বেলায় বাংলাদেশও তা করতে পারেনি। মানবিকতার নজির স্থাপন করেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় প্রথম দিক থেকে মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেছে। এক বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ক্যাম্পের আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত।

আন্তর্জাতিক আদালতে একটি প্রি-ইনকোয়ারি হচ্ছে এবং এটাকে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা ন্যায়বিচারের হাত থেকে রেহাই পাবে না। বাংলাদেশ যুদ্ধ করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করবে না। 

এম হুমায়ুন কবির
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টটি সিরিজ আকারে প্রকাশ করার জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট সম্পর্কে অনেকের জানার আগ্রহ রয়েছে। প্রথম আলো সাধারণ মানুষকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া প্রসঙ্গে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্নভাবে আলোচনা হচ্ছে।

বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং সাধ্যমতো সেবা প্রদান করছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক তহবিল জরুরি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনের কাজের সমন্বয় সাধন করা দরকার। জাতিসংঘ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে সহযোগিতা করায় আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জায়গায় বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। চ্যালেঞ্জের দুটি দিক সম্পর্কে বলা দরকার। প্রথমত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের সমস্যাটি উপলব্ধি করাতে পেরেছি। সমস্যাটি সমাধান হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে মিয়ানমারও স্বীকার করে যে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার।

আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, নিরাপদে ও সসম্মানে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যে এ সমস্যার যৌক্তিক ও কার্যকর সমাধান নিহিত রয়েছে।

দুটো জায়গায় আমাদের চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা হয়েছে। এক. মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে না। সে দেশের গণমাধ্যম, সামরিক বাহিনী এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনসমর্থন নিয়ে আসতে হবে।

এ জন্য আমাদের দূতাবাসকে কাজে লাগাতে পারি। জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে মিয়ানমার তাদের দেশের গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। আমাদের বেলায় এ জায়গাটি এখনো দুর্বল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণকে প্রকৃত সমস্যাটি বোঝাতে হবে। তাহলে একটা পরিবর্তন আসতে পারে।

প্রয়োজনে ক্যাম্পেইন করতে হবে, যেন সামরিক বাহিনী ও কিছু উগ্র সংগঠন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস কাজটি পরিচালনা করেছে, তা মিয়ানমারের মানুষ জানতে পারে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এটি তাদের বোঝাতে হবে।

দুই. জুডিশিয়াল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের মতো আরও মিশন পাঠানোর জন্য সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপনের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেন বাংলাদেশকে সমর্থন করে তার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। 

আমেনা মহসীন
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জনগণের সামনে রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। মিয়ানমারে ইতিহাস লেখার একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। সম্ভবত ১৮২৩-২৪ সালের পর যারা মিয়ানমারে গেছে, তাদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। এর জবাব দেওয়া উচিত।

মিয়ানমারের উপনিবেশ-পূর্ব, উপনিবেশকাল এবং এর পরের ইতিহাস রয়েছে। কাজেই উপনিবেশ-পরবর্তী সময় থেকেই মিয়ানমারের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। আমরা ১৯৭১ সাল থেকে হিসাব করি। দেখতে হবে ১৯৭১ সালের পর এখান থেকে কেউ গেছে কি না। আমাদের জোরালোভাবে দেখাতে হবে যে অভিবাসনপ্রক্রিয়া একটা প্রাকৃতিক বিষয়। এটা হয়তো উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে একটা ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। ঔপনিবেশিক সময়ের ইতিহাসের দায়ভার কেন আমাদের নিতে হবে? তখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ছিল না। ওরা বাংলাদেশ থেকে যায়নি। এই বিষয়টি আমাদের জোর দিয়ে দেখাতে হবে।

মিয়ানমারের প্রথম সংবিধান তুলে ধরতে হবে। প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিল। ১৯৬২ সালের পর মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন হয়েছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে এই পরিবর্তন এসেছে। এটি আমাদের দেখাতে হবে।

গণহত্যা হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি রোহিঙ্গাদের বড় বিজয় বলা যেতে পারে। তারা এত দিন নিজেদের নির্যাতিত বলে দাবি করেছে এবং এ স্বীকৃতি তাদের দাবির ভিত্তি।

 প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত ও চীনের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। এ দুটি দেশ চাপ সৃষ্টি করতে পারে। চীনের উচিত কেবল অর্থনৈতিক চিন্তা না করে নৈতিকতার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। ওআইসি ও আসিয়ানও সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে। সেখানে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এসব দেশকে নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তৈরি করা যেতে পারে। 

মো. সাজ্জাদুল ইসলাম
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তরের মধ্য ভাগ করে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তর রোহিঙ্গা শিশুদের সুরক্ষার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করবে এবং কর্মসূচি গ্রহণ করবে।

এই ধারাবাহিকতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ শুরু করে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৮৪১ জন শিশুর তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এসব শিশুর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করা হয়। ইউনিসেফের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর এবং শিশুদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে হস্তান্তর করা হয়। শিশুদের মাসিক আর্থিক সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

মাঠপর্যায়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের শতাধিক কর্মী কাজ করেন। কর্মীরা প্রতি বাড়িতে গিয়ে শিশুদের যত্ন ও প্রদত্ত টাকার সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কে তদারক করেন। এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬০৫ জন শিশুকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে সক্ষম হয়েছি।

এ মাসে আরও ২ হাজার শিশুকে সাহায্য প্রদানের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। আগামী মাস থেকে সর্বমোট ৫ হাজার শিশুকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। পিতৃমাতৃহীন ও সঙ্গীহীন শিশুদের মনোসামাজিক কাউন্সেলিংসহ অন্যান্য সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

তবে শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ক্যাম্পে মোট শিশু আছে প্রায় ৪ লাখ। প্রত্যাবাসনে ১০-১২ বছর অতিবাহিত হলে এসব শিশু যুবকে পরিণত হবে। শিশুদের এমনভাবে শিক্ষা প্রদান করতে হবে, যেন তারা সম্পদে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে কাজে লাগানো যায়। 

নাজমুল আযম খান
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে পয়লা অক্টোবর ৬০ শয্যার একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। এ হাসপাতালের মাধ্যমে সার্জারিক্যাল চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ১৭টা ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ক্লিনিক সেখানে রয়েছে। তবে স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।

১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ২ লাখ ৫০ হাজার শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন করতে ১২ বছর সময় লেগে যায়। সে হিসেবে ১০ লাখ শরণার্থীকে ফেরত পাঠাতে কত সময় লাগতে পারে? এটি আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণে বিবেচনা করতে হবে। ১৯৯২ সালে কোনো ক্যাম্পেই ২ হাজারের বেশি শরণার্থী রাখার ব্যবস্থা ছিল না। অথচ উখিয়ায় ৮-১০ লাখ শরণার্থী একত্রে বসবাস করছে।

ক্যাম্পে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তার বিষয়টিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। 

আসিফ মুনীর
রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে দুটি দিক নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। একটি হলো মানবাধিকার। অন্যটি মানবিক দিক। রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে আবাসনের বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।

একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নিজ দেশে আশ্রয় না পেলে দ্বিতীয় দেশে আশ্রয় গ্রহণ করবে। সেখানেও সমস্যা হলে তৃতীয় দেশে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা বিশ্বের যেকোনো দেশ হতে পারে।

বিবিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় এখন পর্যন্ত দেড় লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ১ হাজার এবং থাইল্যান্ডে ৫ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা গেলে ভিন্ন দেশেও স্থানান্তর করা সম্ভব। অন্যান্য দেশেও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। শুধু বাংলাদেশ একা এ দায় নেবে কেন?

রোহিঙ্গা সমস্যা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। তাই এটা সমাধান করা বাংলাদেশের একার দায়িত্ব নয়। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং এদের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো রয়েছে, তাদের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা উচিত। 

রিফাত বিন সাত্তার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সুরক্ষায় ১৯১৯ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনের জন্ম হয়। ওই ঘটনার ১০০ বছর পর বাংলাদেশে প্রায় একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু। একটা বড়সংখ্যক শিশু পরিবারবিচ্ছিন্ন।

সেভ দ্য চিলড্রেন ইউনিসেফের সহায়তায় শিশু ও কিশোরীবান্ধব স্পেস তৈরি করেছে। এখানে শিশুদের বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যে শিশুরা যে বর্বরতা দেখেছে, তা প্রকাশ করছে গণমাধ্যমের সামনে। কোনো কোনো সময় অঝোরে কেঁদেছে। সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুদের এ জায়গা থেকে বের করে আনতে সাহায্য করছে। সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে শিশুদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্রিক কারিকুলাম তৈরি করেছে।

এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ভাষা ও ইংরেজিতে তাদের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে। আমাদের শতাধিক সাময়িক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। প্রথম দিকে আমরা মহামারির আশঙ্কা করেছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কর্মসূচি ও স্থানীয় মানুষের সহায়তায় তা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

আর্থিক তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রায় ৯৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি বড় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আমরা পেয়েছি। সংকট যত বাড়বে, এর প্রয়োজন তত বাড়বে। দুঃখের বিষয় এই যে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ তত কমতে পারে। 

মো. নিজামুল হক
প্রায় ১১ লাখ মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং এর কারণ সবাই জানি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়া মিয়ানমারের নৈতিক দায়িত্ব। পৃথিবীর মানুষগুলোর উচিত মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করা। এই ব্যাপারটায় আমরা পিছিয়ে আছি। কীভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

নিজ দেশে সব ধরনের অধিকার যেন রোহিঙ্গারা ফিরে পায়, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। তাদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে।

পত্রিকায় দেখলাম, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে কিন্তু নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না। তার মানে, তোমাকে সব দিলাম। আবার সব কেড়ে নিলাম। এটার কোনো অর্থ হয় না।

অং সান সু চি যে ধরনের ভূমিকা নিতে পারতেন, তিনি সেটা মোটেও নেননি। তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তৃতীয় কোনো দেশে তাদের আবাসন নিশ্চিত করা জরুরি। 

বরকত উল্লাহ মারুফ
কোস্ট ট্রাস্ট ২০০০ সাল থেকে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু করে। গত বছরের ২৬ আগস্ট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় অবস্থান করার সময় স্থানীয় জনগণের সহায়তায় কোস্ট ট্রাস্ট খাদ্য, খাওয়ার পানি এবং বস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। সবার আগে স্থানীয় জনগণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিশোরী শরণার্থীদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয়রা নিজের বাড়িতে আশ্রয় প্রদান করেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি স্থানীয় জনগণকে দেওয়া উচিত।

কেবল তহবিল দিয়ে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব না। সুষ্ঠু সমাধানের জন্য গোটা সমাজকে একত্রে কাজ করতে হবে। স্থানীয় জনগণ, দাতা সংস্থা ও সরকার সবাইকে নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। জায়গা বাড়াতে হবে।

পরিবেশদূষণ রোধ করতে হবে। আমরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেছি। গবেষণায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা স্থানীয় জনগণের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, তা দেখানোর চেষ্টা করেছি।

পরিবেশ ও বন উজাড়ের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে মানুষ পানির জন্য ছোট ছোট খাল বা ছড়ার ওপর নির্ভরশীল। সেখানে প্রায় ৪৬টি খাল চরমভাবে দূষিত হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, জনগণের ব্যবহার করার মতো বিশুদ্ধ পানি আর নেই। ৭৫ শতাংশ অগভীর নলকূপ পানি পাচ্ছে না। আমাদের ১০টা গভীর নলকূপ রয়েছে। পানির জন্য গত জানুয়ারি পর্যন্ত অতিরিক্ত ১৫০ ফুট গভীরতা বাড়াতে হয়েছে। টেকনাফে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ।

তহবিল ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও ব্যবস্থাপনা খরচ সর্বোচ্চ কমিয়ে আনা উচিত। 

রাশেদ খান মেনন
আমরা আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজকে এগিয়ে না আসার জন্য দোষারোপ করছি। কিন্তু আমাদের সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কী ঘটেছে রাখাইন রাজ্যে, তা মিয়ানমারের জনগণ জানে না। এমনকি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমঝোতার জন্য মিয়ানমারে যাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বজনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও মিয়ানমারের জনগণকে প্রকৃত বিষয়টি জানাতে সক্ষম হইনি।

রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে ইয়াবা সমস্যাও জড়িত। সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করা না গেলে এ সমস্যা সমাধানে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণমাধ্যম ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে পরিচয় করাতে যতটা সক্ষম হয়েছে, তার বিপরীতে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে জনমত সৃষ্টির কাজটা আমরা সেভাবে করতে পারিনি।

তারা যেভাবে ইতিহাস রচনা করেছে, তার পাল্টা ইতিহাস আমরা রচনা করতে সক্ষম হইনি। ট্র্যাক-২ ডিপ্লোম্যাসি (দেশে–বিদেশে জনমত সৃষ্টি) গঙ্গার পানি চুক্তির ক্ষেত্রে বিরাট কাজে দিয়েছে। এটা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি না বলে আমার মনে হচ্ছে।

তৃতীয় কোনো দেশে আবাসনের যে কথাটি বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে প্রথম দিকে জাস্টিন ট্রুডো ও তুরস্ক তাদের দেশে কিছু রোহিঙ্গা নিতে প্রস্তাব করেছে। আন্তর্জাতিক মহলে চাপ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।

তৃতীয় কোনো দেশে রোহিঙ্গাদের আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির একটা উপায় বের হতে পারে। শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। তারপরও শিশুদের ভবিষ্যৎ বিষয়গুলো আমাদের আমলে নিতে হবে।

স্থানীয় জনগণ আশ্রয় দিয়েছে তা নিশ্চিতভাবে প্রশংসনীয়। কিন্তু এর ফলে স্থানীয় জনগণের মজুরি কমে যাচ্ছে, কর্মপরিধি কমে যাচ্ছে—এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় রোহিঙ্গাদের আবাসন হয়তো এ দেশের মানুষ মেনে নেবে না। আশার কথা এই যে রোহিঙ্গাদের হত্যার ঘটনাটি গণহত্যা হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন করেছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেও ২৫ মার্চের হত্যাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি।

রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। আরও দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। আমরা অপেক্ষায় আছি। তবে এই অপেক্ষা যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

গওহার নঈম ওয়ারা
তৃতীয় দেশে কেবল প্রত্যাবাসন করা নয়, পাশাপাশি একটা পারিবারিক পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। তাহলে বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যরা মিলিত হতে পারবে।

ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে শিশু সুরক্ষা, বিশেষ করে পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য সামাজিক পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা উচিত। রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার কাজে অনেক বেশি অপ্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় হয়। অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও বেশি সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন। 

আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনায় গত এক বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সুপারিশগুলো নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।