এমন অপমান কেন হজম করল সৌদি আরব?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। ছবি: রয়টার্স

কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই তো মাস দুয়েক আগের ঘটনা। গরম তেলে পানি পড়লে যেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে, সৌদি আরবের দশাও ঠিক তেমন হয়েছিল।

সৌদি আরবে অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে ছিল কানাডা। কারাবন্দী অধিকারকর্মীদের মুক্তি দিতে রিয়াদের প্রতি অটোয়া আহ্বান জানিয়েছিল।

আর দশটা দেশের মতো কানাডার অনেকটা রুটিনমাফিক এই আহ্বানে সৌদি আরব তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। রিয়াদের রাগী পদক্ষেপের তালিকা বেশ দীর্ঘ। তারা কানাডার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনে। কানাডার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। কানাডায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতকেও প্রত্যাহার করা হয়। কানাডার সঙ্গে সব ধরনের নতুন বাণিজ্য-বিনিয়োগ স্থগিত করে রিয়াদ। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা টরন্টোর সঙ্গে বিমান যোগাযোগ স্থগিত করে। কানাডায় অধ্যয়নরত সৌদি আরবের হাজারো শিক্ষার্থীকে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়।

অটোয়ার ব্যাপারে রিয়াদের হঠাৎ এমন গরম প্রতিক্রিয়ার পর পর্যবেক্ষকেরা বলছিলেন, সৌদি আরব আসলে ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর কৌশল নিয়েছে। তারা কানাডাকে কড়া জবাব দিয়ে অন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। এই বার্তা হলো সৌদি আরবের সঙ্গে বুঝেশুনে কথা বলো।

মাত্র দুই মাসের মাথায় সৌদি আরবের ‘মুই কী হনু রে’ ভাব ভরা মজলিশে মাটিতে মিশে গেছে। রিয়াদের গর্বের গুমর ফাঁসের কাজটি অন্য কেউ করেনি। করেছে তার পেয়ারের দোস্ত যুক্তরাষ্ট্র।

সম্প্রতি মিসিসিপিতে এক শোভাযাত্রায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, সৌদি আরবকে রক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি সৌদি বাদশাহর উদ্দেশে বলেছেন,‘বাদশাহ, আমরা আপনাকে রক্ষা করছি। আমাদের সমর্থন ছাড়া আপনি দুই সপ্তাহও টিকবেন না।’

কানাডার সঙ্গে সৌদি আরবের রূঢ় আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই হয়তো ওয়াশিংটনের ব্যাপারে রিয়াদের কাছ থেকে প্রায় একই জবাব আশা করেছিলেন। মনে মনে হয়তো ভেবেছিলেন, এবার দোস্তি ছুটে যাবে। কিন্তু কিসের কী?

কানাডার বিবৃতির সঙ্গে তুলনা করলে ট্রাম্পের খোঁটা নিঃসন্দেহে সৌদি আরবের জন্য চরম অপমানের। কিন্তু ট্রাম্পের মন্তব্যে সৌদি আরব অপমানিত বোধ করলেও চোখ বুজে তা হজম করেছে বলেই মনে হয়।

কানাডার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া ছিল ত্বরিত। কিন্তু ট্রাম্পের মন্তব্যের জবাব দিতে রিয়াদ সময় নিয়েছে চার দিন। আর তাদের প্রতিক্রিয়াও বেশ ‘কুল’—নিস্তেজ।

সৌদি আরবের মসনদে সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ থাকলেও দেশটির বর্তমান হর্তাকর্তা তাঁর তরুণ ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ট্রাম্পের মন্তব্যের জবাব তাঁর কাছ থেকেই এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করে যুবরাজ বলেন, ‘বন্ধুরাষ্ট্র ভালো-মন্দ যেকোনো কিছুই বলতে পারে। ট্রাম্প যা-ই বলুন, তিনি তাঁর (ট্রাম্প) সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসেন।’

কথায় বলে, ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’। কানাডাকে নরম পেয়ে ইচ্ছেমতো গরম দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করেনি সৌদি আরব। কিন্তু উদ্ধত যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সৌদি আরবের স্বর কোমল হয়ে যায়। চড়া গলায় পাছে যদি ওস্তাদ মাইন্ড করে বসে!

ট্রাম্প মিথ্যা বলেননি। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি ও ইসরায়েলি দাপটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের সাহায্য, সমর্থন ও আশকারায় পুরো অঞ্চলে বেপরোয়াভাবে ছড়ি ঘুরিয়ে চলছে রাষ্ট্র দুটি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি

২০১৭ সালের মে মাসে ট্রাম্প তাঁর প্রথম বিদেশে সফরে সৌদি আরব যান। ট্রাম্পের সৌদি সফরে ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে কয়েক শ কোটি ডলারের চুক্তি হয়। এই চুক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র কেনার বিষয়টিও আছে। এটি সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অস্ত্র চুক্তি। ট্রাম্পের এই সফর সৌদি আরবের স্পর্ধা বাড়িয়ে দেয়। তারা আস্ফালন দেখানোর মওকা পেয়ে যায়। বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে নতুন সৌদি আরবের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ট্রাম্পের সফরের পর গত জুনে সৌদি আরব ও তার কয়েকটি মিত্র দেশ একযোগে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করে। কাতারকে একঘরে করার পদক্ষেপ আরব বিশ্বে সৌদি আরবের আধিপত্য বিস্তার-চেষ্টারই অংশ। এতে যুক্তরাষ্ট্রও সায় দেয়।

সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক দেশ। তাদের তেলের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। তেলের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডলার যায় সৌদি আরবে। আবার সৌদি আরবের তেলসম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। স্বার্থ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কিচ্ছু করে না। দেশটির তেল দরকার। এ জন্য তারা সৌদি আরবকে কাছে রাখছে।

সৌদি আরবের অস্ত্রের বড় জোগানদারও যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প নিজেই সদর্পে ঘোষণা করেছেন, সৌদি আরব মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, সৌদি আরবের আমদানি করা অস্ত্রের ৬১ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে মার্কিন সেনা ও বিশেষজ্ঞরা সৌদি আরবে কাজ করে যাচ্ছেন। সামরিক-বেসামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ-পরামর্শের নামে এই তৎপরতা চলছে। আমেরিকান সিকিউরিটি প্রজেক্ট বলছে, মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষণ মিশনের অংশ হিসেবে সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের এখনো অনেক সামরিক সদস্য অবস্থান করছেন। রিয়াদের কাছেই তাদের ঘাঁটি আছে।

২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে। এই অভিযানে সৌদি আরবকে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা সৌদি আরবের যুদ্ধবিমানকে জ্বালানি সরবরাহ ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি মারণাস্ত্র ইয়েমেনে ব্যবহার করছে সৌদি আরব। এমনকি ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে সহায়তার লক্ষ্যে গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী মোতায়েনের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।

গাঁওগ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে, দুধেল গাভির লাথিটাও মধুর লাগে। এই কথার মধ্যেই ট্রাম্পের কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্যের জবাবে সৌদি যুবরাজের নরম সুরের মর্মার্থ লুকিয়ে আছে। সৌদি আরবকে ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চলতে পারবে। কিন্তু সৌদি আরব কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া তা পারবে?

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]