বেহাল এডিপি

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন নিয়ে পুরোনো অভ্যাস আর বদলাল না। অর্থবছরের প্রথম দিকে কর্তাব্যক্তিরা কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। যখন তাঁদের ঘুম ভাঙে, তখন বছরের অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। সত্য যে এক দশক আগের তুলনায় আমাদের এডিপির বরাদ্দ উচ্চ হারে স্ফীত হচ্ছে। কিন্তু সময়মতো সেই বরাদ্দ খরচ না হওয়ার আক্ষেপ থেকেই গেল।

 অর্থবছরের শুরুতে শ্লথগতি আর শেষ দিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে তাড়াহুড়ো করায় যে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না, সে বিষয়টি বুঝতে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এককালে এডিপি বাস্তবায়নের মন্থরগতির জন্য বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং তাদের তরফে টাকা যথাসময়ে ছাড় না হওয়া সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু এখন দেশীয় অর্থায়নেই সিংহভাগ কাজ হয়ে থাকে।

নির্বাচন সামনে রেখে সরকার উন্নয়নের গতি বাড়াতে চাইবে, সেটা প্রত্যাশিত হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক। চলতি অর্থবছরের চার ভাগের এক ভাগ সময় চলে গেছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাত্র ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হওয়া মোটেই সংগত নয়। উদ্বেগজনক হলো উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবারও লাল ফিতায় আটকে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর জন্য প্রকল্প পরিচালক না অর্থ মন্ত্রণালয় বেশি দায়ী তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু যাদের এসব প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাদের বঞ্চনার অবসান হবে না।

ক্ষমতাসীন দলের এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যাঁরা ভোট টানতে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করানোর বিষয়ে উদাসীন থাকবেন। বরং বাস্তবতা হলো তদবির ও তোষামোদ করে অনেক প্রকল্প অনুমোদন করানো হয়, যার উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখানে উপযোগিতার চেয়েও সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বহুবার যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতে যে সংশ্লিষ্টদের চৈতন্যোদয় হয়নি, প্রথম আলোর প্রতিবেদনই তার প্রমাণ। উন্নত দেশ তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী ভারতের অবকাঠামো তথা সড়ক সেতুর স্থায়িত্বের সুনাম আছে। কিন্তু আমাদের দেশের সড়ক বা দালানকোঠা নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন না যেতেই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় কেন? এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করা। বছরের শেষে কাজের গুণমান না দেখে ৩০ জুনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে বরাদ্দ তুলে নিতেই প্রকল্প পরিচালক–ঠিকাদারেরা বেশি উৎসাহী থাকেন। উন্নয়নের নামে এই তামাশা চলতে দেওয়া যায় না।

গত শুক্রবার প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন বলেছে, ভোট টানতে প্রকল্প পাসের মহোৎসব চলছে। শেষ সময়ে ঘন ঘন একনেক সভা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার ১২৬টি প্রকল্প পাস হয়েছে। কিন্তু লাল ফিতার এমনই দৌরাত্ম্য যে সরকার যতই টাকা খরচে উদার হোক না কেন, চাইলেই টাকা পাওয়া যাবে না। পেলেও সময়মতো খরচ করা হবে না।

আমরা ধারণা করতে পারি, ভোটের আগে গ্রামেগঞ্জে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ফিতা কাটার একটা হিড়িক লেগে যাবে। কিন্তু সেসব প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে না। উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের এই অপচয় কবে বন্ধ হবে?