বাংলাদেশে টি এন সেশন কী করতেন

১ অক্টোবর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে একজন ‘চেঞ্জমেকার’–এর খোঁজে নামে আলতাফ পারভেজের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক। তিনি ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের (১৯৯০-৯৬) সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত এবং সে দেশের নির্বাচনী রাজনীতির অনাচার দূর করতে তাঁর অবিচল সংগ্রামের সাফল্য তুলে ধরেন। লেখক মন্তব্য করেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজ ও রাজনীতির জগদ্দল পাথর সরাতে অনেক টি এন সেশন দরকার।

আলতাফ পারভেজ আরও লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জরুরি বটে। এখানে বারবার নতুন নির্বাচন কমিশন ও কমিশনার আসেন। তবে দেশটির দরকার চেঞ্জমেকার।’ লেখকের সদিচ্ছার সঙ্গে আমি একমত। তবে দেখতে হবে, সেশন ভারতে কী পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পেরেছিলেন। তাঁর সাফল্যের প্রেক্ষাপটটি কী। আমাদের দেশে টি এন সেশনের মতো ন্যায়নিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল কোনো ব্যক্তিকে যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে বসানো হয়, তাহলে তিনি সফল হবেন কি না। টি এন সেশন ভারতে যে সহায়ক কর্মপরিবেশ পেয়েছিলেন, বাংলাদেশে তা আছে কি না।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই সিইসির ক্ষমতার উৎস সংবিধান। এ ছাড়া সময়ে সময়ে জারিকৃত বিভিন্ন আইনও সে ক্ষমতার ভিতকে আরও মজবুত ও প্রসারিত করেছে। বিশ্লেষকদের বিবেচনায় আমাদের নির্বাচন কমিশনের আইনি ক্ষমতা ভারতের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে বরং জোরালো। তাহলে প্রশ্ন, ভারতে পারলে বাংলাদেশে পারা যাবে না কেন? শুধু সেশনের মতো একজন সিইসি নিয়োগ দিলেই সব সমস্যা কেটে যাবে?

গভীরে গেলে দেখা যাবে, বিষয়টি অনেক জটিল। ভারতের নির্বাচন কমিশনের জনবল কমবেশি ৩০০। আমাদের ইতিমধ্যে চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পরিকল্পনা আছে সাত হাজারে উন্নীত করার। বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নির্বাচনের দায়িত্ব দিলে সরকারের হস্তক্ষেপ কম হবে। দায়িত্ব তো বিভিন্ন সময়ে দেওয়াই হয়। দেওয়া হয়েছিল হালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতেও। আরও বলা হয়, দলীয়করণকৃত প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন করা যাবে না। ১৯৯১ থেকে চারটি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। এর আগের সরকারগুলো প্রশাসন দলীয়করণ করেছিল। কিন্তু ক্ষমতার নাটাই হাতছাড়া হওয়ার পর সে প্রশাসনই তো চারটি সফল নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়েছে।

আলতাফ পারভেজ তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ভারতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেই সিইসি সেশন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃত্ব নিজ হাতে নিয়ে নিতেন। তাদের বদলি করা বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন নির্মমভাবে। সেশন আয়কর বিভাগের লোকদের পাঠাতেন নির্বাচনের প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় তদারক করতে। এমনটা করতে গিয়ে তিনি সর্বক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সমর্থন পেয়েছেন। একবার তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর চাহিদা অনুসারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ না দেওয়ায় তিনি সে নির্বাচন স্থগিত করেন। এতে নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘিত হয়েছিল। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। আদালতের মতে, নির্বাচন মানে গণরায়, গণরায় আনতে হবে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা অপ্রতুল হলে তা সম্ভব হবে না। আদালতের রায় হয়েছিল সিইসি সেশনের সিদ্ধান্তের অনুকূলে। তাঁর সফল হতে আর কি তেমন কিছু লাগে?

আমাদের দেশে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সংসদের তেজগাঁও উপনির্বাচনে এবং মহাজোট সরকারের সময়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সুপারিশ করলেও সরকার তা মানেনি। এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু সে জন্য কারও কিছু হয়নি।

ভারতের সঙ্গে আমাদের শাসনব্যবস্থার মিল–অমিল দুটোই আছে। অমিলের মধ্য বড় অমিল আমাদের ক্ষমতার কেন্দ্র একটি মাত্র স্থানে, ভারতে সেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। মিল হলো, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ভারতেও হয়েছে। সে জন্য টি এন সেশনের নেওয়া ব্যবস্থা সর্বাংশে টেকসই হয়নি। ভারতের
সূচনা থেকেই সংসদীয় ব্যবস্থা কাজ করছে। নির্বাচন নামক ব্যবস্থাটি ক্ষতবিক্ষত হয়নি। ১৯৭৭ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর দল লোকসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়। সেশনের আগে অনিয়ম ছিল অনেক। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সেগুলো দূর করেন। তিনি কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকার সব কেন্দ্রে একাধিকবার ভোট গ্রহণ করেন। যুক্তিগ্রাহ্য অভিযোগ এলেই নির্বাচন বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের আদেশ দিতেন। তিনি এসব ক্ষেত্রেও আদালতের সমর্থন পেয়েছিলেন। চক্ষুশূল ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদদের। কিন্তু জনগণের নায়ক হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন নির্বাচনে মিথ্যা হলফনামা দেওয়ার জন্য প্রায় ১৪ হাজার প্রার্থীকে তিন বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছেন। আলতাফ পারভেজ তাঁর লেখায় মন্তব্য করেছেন, ভারতের সিইসি টি এন সেশনের কার্যকাল ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ খণ্ড যুদ্ধের সমাহার।

টি এন সেশন ছিলেন ভারতীয় প্রশাসনিক সার্ভিসের (আইএএস) ১৯৫৫ ব্যাচের অফিসার। ১৯৮৯ সালে হন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি অনমনীয় মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন, তাঁর আনুগত্য ছিল দেশের সংবিধান, আইন ও জনগণের প্রতি। এ রকম একজন কর্মকর্তাকে আমাদের দেশে কোনো দলীয় সরকার কি সিইসি করত? ভারতেও তিনি সিইসি হয়েছিলেন একপ্রকার রাজনৈতিক শূন্যতার সময়ে। চন্দ্র শেখর ভি পি সিং মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে বিরোধী কংগ্রেস দলের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হন। কদিন পরেই কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে। আয়োজন করা হয় মধ্যবর্তী নির্বাচনের। বস্তুত ছয় মাস ছিল চন্দ্র শেখরের কার্যকাল। অনেকটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতোই। সেই চন্দ্র শেখরের সামনে আর কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ছিল না।

শুধু এ কারণে নয়, সে দেশটিতে অনেক ক্ষেত্রে এখনো যোগ্যতা–দক্ষতার মূল্যায়ন করা হয়। সেশনের ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছিল। ভারতে আইএএস সদস্যদের রাজ্য ও কেন্দ্র—উভয় স্থানে কাজ করতে হয়। তাঁরা রাজনীতির গতি–প্রকৃতি সতত পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু চাকরিকালে এতে জড়িয়ে পড়েন না। আনুগত্য থাকে সরকারব্যবস্থার প্রতি। তামিল ব্রাহ্মণ টি এন সেশনও কাজ শুরু করেছিলেন তামিলনাড়ু (তখন মাদ্রাজ বলা হতো) থেকে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের এককালের কিং মেকার কামরাজ। সেশন তাঁর দ্য ডিজেনারেশন অব ইন্ডিয়া বইটিতে সেসব দিনে স্থানীয় রাজনৈতিক চাপের কথা লিখেছেন। অন্যদিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখেছেন আইনের শাসনের প্রতি কামরাজের অবিচল সমর্থনের কথা। বিপত্নীক সেশন এখন দিন কাটাচ্ছেন তামিলনাড়ুরই এক বৃদ্ধ নিবাসে।

এসব আলোচনার উদ্দেশ্য টি এন সেশনের কর্মক্ষেত্র ও পরিবেশের সঙ্গে আমাদের ব্যাপক ভিন্নতা তুলে ধরা। এ দেশে নির্বাচন কমিশনার ছাড়াই পূর্ববঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের নিয়ন্ত্রণে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল মারাত্মকভাবে হেরেছিল। আর ’৯১–পরবর্তী গণতন্ত্রে উত্তরণের পরও বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোনো নির্বাচনই বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকছে না। তাই আলতাফ পারভেজের মতো অনেকেই ভাবেন টি এন সেশনের মতো একজন সিইসি পেলে আমাদের পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। তিনি হবেন একজন চেঞ্জমেকার।

কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি ভিন্ন। যেসব নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের সাফল্য দেখা গেছে, সেসব নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। কমিশন সাংগঠনিক কাজ করেছে দক্ষতার সঙ্গে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের বুঝতে হবে, অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হবে। সরকার বৈধতা খুঁজতে নির্ভরশীল হবে অন্যদের ওপর। এটা বুঝতে পারলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের সূত্র খুঁজে পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে প্রভাবিত করতে জনগণেরও বড় ধরনের ভূমিকা আছে, অতীতে জনগণ তা দেখিয়েছে। সংবিধান, আইন সবকিছুই জনগণের জন্য। জনগণের দ্বারা প্রণীত, জনগণ এসব দলিলের সৃষ্ট নয়। তাই হয়তো এ দেশেও একদিন বেরিয়ে আসবেন কোনো এক টি এন সেশন।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]