গরিবি হটাও

গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবসে প্রথম আলো বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে যে খবরটি ছেপেছে, সেটি উৎসাহব্যঞ্জক। জনসংখ্যার বৃদ্ধি সত্ত্বেও আট বছরে গরিব মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১৫ লাখ কমে যাওয়া উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। তখন দরিদ্র মানুষ ছিল ৪ কোটি ৭০ লাখ, এখন ৩ কোটি ৫৫ লাখ। অথচ জনসংখ্যা বেড়েছে দেড় কোটির বেশি।

একজন মানুষের দৈনিক ২ হাজার ১২২ ক্যালরি পূরণের জন্য যে খাবার প্রয়োজন, তিনি যদি তা কিনতে সক্ষম না হন, তাহলে তাঁর অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর যাঁরা দৈনিক ১ হাজার ৮০৫ ক্যালরি পূরণের লক্ষ্যে খাবার কিনতে পারেন না, তাঁদের অতি বা হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দেশে এখন হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৮৬ লাখ। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬৩ লাখ। সে হিসাবে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশ কমেছে। তবে এই সাফল্যের পরও সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।

সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য’। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও যদি দেশের এক-পঞ্চমাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাহলে ধরে নিতে হবে রাষ্ট্র সেই কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেনি। দ্বিতীয়ত, একজন মানুষের ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার জন্য শুধু ন্যূনতম ক্যালরির খাবারই যথেষ্ট নয়। বস্ত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ আরও অনেকগুলো মৌলিক চাহিদা তাঁকে পূরণ করতে হয়। সেসব বিবেচনায় নিলে মৌলিক চাহিদাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ও গড় আয় দুটোই বেড়েছে। আমরা স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা রেখেছি। এসব সাফল্যের পেছনে নিশ্চয়ই সরকারের সহায়ক নীতি-পরিকল্পনার ভূমিকা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে শ্রমজীবী মানুষ, যাদের মধ্যে প্রথম কাতারে আছে কৃষক, তৈরি পোশাক খাতের নারী শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিক। এদের শ্রম-ঘামে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা দ্রুত সামনে ঘুরছে।

দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের গৃহীত কর্মসূচির অবদান স্বীকার করে বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেসব অনিয়ম–দুর্নীতি চলছে, তা কমাতে পারলে দারিদ্র্যের হার আরও নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হতো। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসূচি বাস্তবায়নে নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তেলা মাথায় তেল দেওয়ার নীতি পরিহার করে সমাজের নিচের মানুষের সুরক্ষায় নিতে হবে টেকসই কর্মসূচি।

এর আগে জাতিসংঘ ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, সেটি বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করেছে, যা বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, যাতে দারিদ্র্যের হার শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, মানসম্মত শিক্ষা ও সব নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি জড়িত। দেশের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৩৮ শতাংশ সম্পদ আর ১০ শতাংশের কাছে ১ শতাংশ সম্পদ থাকার যে বিরাট বৈষম্য, তা না কমিয়ে দারিদ্র্যের হার শূন্যে নামিয়ে আনা কঠিন হবে।

অতএব, সরকারকে এখন সমতাভিত্তিক অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের ওপরই বেশি জোর দিতে হবে।