তুমি যুবরাজ ধরা খেলে আজ

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের যুবরাজ হলে চারদিকে ‘মারহাবা মারহাবা’ আওয়াজ পড়ে যায়। সবাই বলতে থাকে, অবশেষে সৌদি আরব একজন যুবরাজের মতোই যুবরাজ পেল।

শিক্ষিত, আধুনিক ছেলে। বয়স কম। ব্লাডও ফ্রেশ। পুরো সৌদি আরবকে আমূল বদলে দেওয়ার স্বপ্ন মোহাম্মদ বিন সালমানের। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজসংস্কার নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা শুনে প্রত্যাশার বেলুন ফুলে ওঠে। কিন্তু হায়! সেই বেলুন এখন ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। অল্প বয়সে পাকলে যা হয়!

আশা জাগানোর মতো নানামুখী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান শুরু থেকেই সব ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে মরিয়া। রাজপরিবার, প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—যেখানে যাঁকে তিনি হুমকি মনে করেছেন, তাঁকে শায়েস্তা করতে কার্পণ্য করেননি। দেশটিতে বিরোধীদের দমনে জেল, জরিমানা এমনকি প্রাণদণ্ড দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

হুট করে শোনা গেল, দুর্নীতিবিরোধী চিরুনি অভিযান শুরু করেছেন নতুন যুবরাজ। রথী-মহারথী ধরা পড়ল। দূর থেকে সবাই চোখ বড় করে বলতে লাগল, দারুণ তো! বিস্ময়ের রেশ না কাটতেই খবর বের হয়, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে মোহাম্মদ বিন সালমান আসলে তাঁর বিরোধীদের বন্দী করেছেন। পরে কেউ কেউ অবশ্য যুবরাজকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে ‘মুক্তি’ কিনেছেন।

বিগত আমলে সৌদি আরবের অনেক ‘বদনাম’ হয়েছে। এই ‘বদনাম’ ঘোচাতে যুবরাজ ভাবমূর্তি উন্নয়নের প্রজেক্ট নিলেন। মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা দিলেন, উদার নীতিতে ফিরে যাবে তাঁর সৌদি আরব। গাড়ি চালানোসহ নারীদের কিছু অধিকার দেওয়া হলো। সিনেমার পর্দা উঠল। কথিত সংস্কারের খুশিতে সবাই যখন তালি বাজাতে ব্যস্ত, তখন যুবরাজ নারী অধিকারকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর চড়াও হলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করলেও তাঁর খবর হয়ে যাচ্ছে।

সৌদি বাদশাহ সালমান। ছবি: রয়টার্স
সৌদি বাদশাহ সালমান। ছবি: রয়টার্স

অনেক হয়েছে, আর নয় মিনমিনে ভাব। যুবরাজ ঠিক করলেন, এবার জগৎটাকে সৌদির শৌর্য দেখাবেন তিনি। তো, কীভাবে তা সম্ভব? কাছেই ইয়েমেন। সেখানে চলছে গৃহযুদ্ধ। ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য এ দেশটিকেই বেছে নিলেন তিনি। শুরু হলো বোমা বর্ষণ। কে ঠেকায় তাঁকে! ইয়েমেনে শিশুসহ নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। সবাই সৌদি আরবকে হামলা বন্ধ করতে দোহাই দিচ্ছে। যুবরাজ তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। যায় যদি যাক প্রাণ, সৌদি যুবরাজ ক্ষমতাবান।

ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে ক্ষমতার গরমটা ঠিক জুতসইভাবে দেখানো যাচ্ছিল না। তাই যুবরাজ গিনিপিগ হিসেবে বেছে নিলেন কাতারকে। দেশটিকে একঘরে করে তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন, সৌদি আরব আর আগের মতো নেই। শাহেনশাকে কুর্নিশ করো, নইলে শাস্তি ভোগ করো।

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি একটু তিড়িংবিড়িং করছিলেন। তাঁকে রিয়াদে ডেকে মোহাম্মদ বিন সালমান এমন সাইজটা না দিলেন যে, বেচারা সেখানে বসেই পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। নানা নাটকীয়তার পর তিনি দেশে ফিরে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন।

আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানকে কোণঠাসা করতে সৌদি যুবরাজ সম্ভাব্য সবকিছুই করে চলছেন। তেহরানকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে শয়তানের সঙ্গে হাত মেলাতেও তাঁর দ্বিধা নেই। তার সাক্ষাৎপ্রমাণ ইসরায়েলের সঙ্গে তাঁর ‘দোস্তি’। আর তাদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র তো আছেই।

যুবরাজের হাবভাব দেখে অভিজ্ঞজনেরা প্রথম থেকেই বলে আসছেন, মোহাম্মদ বিন সালমান সবকিছুতেই বড্ড তাড়াহুড়া করছেন। ক্ষমতার মোহে তিনি বিপজ্জনক খেলায় মেতেছেন।

ময়মুরব্বিদের কথা ফলতে শুরু করেছে। বিরোধীদের ঠান্ডা করতে নিজ দেশে যুবরাজ ইতিমধ্যে দমন-পীড়নমূলক অনেক পদক্ষেপই নিয়েছেন। কিন্তু কড়াকড়ির কারণে তার সিকি ভাগ তথ্যও প্রচার হয় না। তবে এবার দেশের বাইরে ‘কিলিং মিশন’ চালাতে গিয়ে গোল পেকেছে। বেকায়দায় পড়েছে সৌদি আরব।

মোহাম্মদ বিন সালমানের কড়া সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। যুবরাজের মতিগতি বুঝতে পেরে তিনি দেশ ছাড়েন। কিন্তু তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। বিয়ের জন্য নথি সংগ্রহ করতে ২ অক্টোবর তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়ে নাই হয়ে যান তিনি।

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি।

আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তাই এখন পর্যন্ত খাসোগির নামের আগে ‘নিখোঁজ’ শব্দ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আলামত বলছে, তিনি আর বেঁচে নেই।

খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে বলে তুরস্ক জোর দিয়ে বলছে। তুর্কি ও মার্কিন গণমাধ্যমে খাসোগি হত্যার লোমহর্ষক বিবরণ আসছে। কিন্তু সৌদি বাদশা ও তাঁর আদরের যুবরাজ কিরা কেটে খাসোগি হত্যার কথা অস্বীকার করছেন।

খাসোগির পরিণতি নিয়ে সৌদির শীর্ষ নেতৃত্বের কথা তাদের প্রাণের বন্ধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করতে পারেন। কিন্তু খাসোগিকে যে খুন করা হয়েছে, তা জনমনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। কার নির্দেশে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো, এ নিয়েও সমীকরণ মেলানো হচ্ছে। অভিযোগের তির সরাসরি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, খাসোগি নিখোঁজের ঘটনায় যে ১৫ জন সৌদি এজেন্টের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে চারজনের সঙ্গে যুবরাজের যোগসূত্র আছে। আর একজন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা।

খাসোগির মৃত্যুর বিষয়টি সৌদি আরব স্বীকার করে নিতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা বানানো হতে পারে। গর্দান যার-ই যাক না কেন, এ কথা সবার জানা, যুবরাজের কথার বাইরে পাতাও নড়ে না। এই খুনের দায় তিনি নেবেন না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু খাসোগির রক্তের দাগও তাঁর পক্ষে মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। ধরাকে সরাজ্ঞান করে আসা মোহাম্মদ বিন সালমান এবার ধরা খেয়ে গেছেন।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]