স্বাধীনতার জন্য অবিরাম লড়াই

বাক্স্বাধীনতা যদি থাকে, তাহলে তা শুধু সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা নয়; ক্ষমতা বা রাষ্ট্র বা সরকার যাকে সত্য বলে স্বীকার করে না, তা প্রকাশ করবারও স্বাধীনতা।

ধরা যাক আমরা শুধু সত্য কথাই প্রকাশ করতে দেব; যা অসত্য, অসম্ভব, কাল্পনিক তা প্রকাশ করতে দেব না, তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়াবে? জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে—এই লাইনটা আমরা আর কোনো দিনও প্রকাশ করতে পারব না। কোনো মানুষের পক্ষেই হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা সম্ভব নয়।

আবার সত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা তো চিরদিন এক থাকে না, সবার বেলাতেও এক হয় না। সক্রেটিসের বিচার করা হয়েছিল। তিনি তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করেছেন, এই অভিযোগে তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ আমরা জানি, সক্রেটিসই ঠিক ছিলেন। যারা তাঁর বিচার করেছিল, তারাই ছিল ভুল।

আমরা সবাই জানি ও মানি, সংবাদমাধ্যমের কাজ সত্য তুলে ধরা। কোন সত্য? কী রকম সত্য? ক্ষমতা কিংবা কায়েমি স্বার্থ কিংবা পুঁজি কিংবা মুনাফা যাকে সত্য বলে প্রচার করতে চায়, তাই? নাকি আমার বিবেক যাকে সত্য বলে জানছে, মানছে এবং দৃঢ় প্রমাণ পাচ্ছে, তা?

আমাদের সরকার খুব বুদ্ধিমান। বড় সচেতন। তাঁরা আইন প্রণয়ন করেন। আমাদের হিতোপদেশ দেন: খবরদার, মিথ্যা কথা বলবে না। আমেরিকার নীতিনির্ধারকেরা খুব বোকা। তাঁদের পিতৃপুরুষগণ খুবই অবিবেচক। অদূরদর্শী। তাঁরা নীতি–আইন বানিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ করে গেছেন। বিস্ময়ের কথা, তা সত্ত্বেও আমেরিকা এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনবান, শক্তিমান দেশ। অধিকাংশ নোবেল পুরস্কার চলে যায় আমেরিকায়।

১৭৯১ সালে আমেরিকান সংবিধানে প্রথম সংশোধনী যুক্ত করা হয়। তাতে বলা হয়, কংগ্রেস এমন কোনো আইন পাস করতে পারবে না, যা বাক্স্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে।

১৯৬৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে বাহুতে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদের ডাক দেন সিনেটর রবার্ট এফ কেনেডি। আইওয়ার এক স্কুলের ১৩ বছরের ছাত্রী ম্যারি ঠিক করে, হাতে কালো কাপড় বেঁধে স্কুলে যাবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, কেউ কালো কাপড় বেঁধে স্কুলে আসতে পারবে না। তা সত্ত্বেও ম্যারি ও তার সহপাঠীরা কালো ব্যাজ বেঁধে যায় স্কুলে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এই অবাধ্য শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করে। তারা মামলা করে দেয়। নিম্ন আদালতে সেই বহিষ্কারাদেশকে বহাল রাখা হয়। মামলা যায় সুপ্রিম কোর্টে। তিন বছর পরে সুপ্রিম কোর্ট স্কুলের বহিষ্কারাদেশকে অবৈধ বলে রায় দেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেন, প্রতিবাদ করা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। ছাত্র বা শিক্ষক কেউই সাংবিধানিক অধিকারকে স্কুল গেটের বাইরে রেখে স্কুলে প্রবেশ করে না।

সুপ্রিম কোর্ট ব্যাখ্যাও দেন: সবাই যা বলছে, একজন যদি তা থেকে ব্যতিক্রমী কিছু বলে তা থেকে ভয় উদ্ভূত হতে পারে। ক্লাসরুমে, খাবার ঘরে, ক্যাম্পাসে কেউ যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে, তা থেকে তর্কবিতর্ক, বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমাদের সংবিধান বলছে, আমাদের এই ঝুঁকি নিতে হবে। এবং ইতিহাস বলছে, এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্বাধীনতা, এই ধরনের খোলামেলা পরিবেশ আমাদের জাতির শক্তি।

১৯৯৫ সালে আমি আমেরিকান সোসাইটি ফর নিউজপেপার এডিটরস এবং ফ্রিডম ফোরামের আমন্ত্রণে প্রথম আমেরিকা যাই। তখন আমাদের হাতে একটা বই দেওয়া হয়। বইটার নাম অ্যান আনফিটারড প্রেস, বন্ধনহীন সংবাদমাধ্যম। বইটার ৩৫ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, ‘একটা খবরের কাগজের অধিকার আছে ছিদ্রান্বেষী হওয়ার বা দল-সমর্থক হওয়ার, অসত্যপূর্ণ হওয়ার বা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার বা যা তার বিবেকে হতে বলে তা হওয়ার।’ এটা আমেরিকানরা বিশ্বাস করে এবং মানে।

কারণ, তা না হলে সরকার বা ক্ষমতাবানেরা বা পুঁজিপতিরা হামলে পড়বে সংবাদমাধ্যমের ওপর। তারা বলবে, এটা তুমি মিথ্যা বলেছ। কিন্তু কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা ঠিক করে দেওয়ার কর্তৃত্ব সরকারকে দেওয়া যায় না। কোনটা শ্লীল কোনটা অশ্লীল সেটা ঠিক করে দেবার দায়িত্বও সরকারের হাতে দেওয়া যাবে না। দিলেই সেটা হয়ে যাবে বানরের হাতে পিঠা ভাগ করার দায়িত্ব তুলে দেবার মতো।

সরকারি সত্য আর জনগণের সত্য অনেক সময়ই এক হবে না। কাজেই সরকারের কাজ হবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করা। শর্তহীন স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

কিন্তু পৃথিবীতে কোনো সরকারই সংবাদমাধ্যমকে পছন্দ করে না। এ দুইয়ের সম্পর্ক সব সময় ভালো থাকে না। তা আমেরিকায়ও না, বাংলাদেশেও না।

কিন্তু তাই বলে সংবাদমাধ্যমের কি কোনো দায়দায়িত্ব বা জবাবদিহি থাকবে না? থাকবে, তা আসবে তার নিজেদের ভেতর থেকে। একটা সংবাদপত্রকে রোজ জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। যে কাগজ মিথ্যা কথা লেখে, পাঠক তা বর্জন করে। বা তার ভাবমূর্তি হয় এই রকম যে এই কাগজের কথা বিশ্বাস করা যায় না। আর আছে মানহানির মামলা। যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মামলা করে দিতে পারে। আমেরিকায় এই ধরনের মামলা দেওয়ানি হয়, ফৌজদারি হয় না। অনেক সময় কোটি কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তবে মানহানির মামলাতেও শুধু খবরটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলেই সাজা হয় না। খবরটি মিথ্যা এবং তা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে এবং এর ফলে ক্ষতি হয়েছে—এটা প্রমাণ করা গেলেই তবে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।

তাই বলি, আমেরিকানরা বোকা। আর বোকা বলেই তার শক্তিতে, ধনে, জ্ঞানবিদ্যায় পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। আমরা চালাক। আমরা প্রতিটা পদক্ষেপে নিষেধের তারকাঁটা বানাচ্ছি। আমরা বলতে দেব না, করতে দেব না। সমবেত হতে দেব না। অথচ আমাদের কবি সেই কবে স্বপ্ন দেখেছিলেন এক মুক্ত স্বদেশের, যেখানে:

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে...

গণতন্ত্রে প্রতিটা মানুষ সমান। প্রতিটা মানুষের সমান অধিকার। প্রত্যেকের এক ভোট। রাজার ছেলের এক ভোট। নুলো ভিখিরিরও এক ভোট। সবাই সমান। চার বা পাঁচ বছরের জন্য আমরা রাষ্ট্রটাকে চালানোর জন্য ম্যানেজার নিয়োগ দিই। তাঁরা আমাদের সেবক, প্রভু নন। কিন্তু তাঁদের হাতে আছে ক্ষমতা, তাই তাঁরা এমন ব্যবহার করতে পারেন, যাতে সাধারণের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। তা যেন না হয়, সে জন্য থাকবে আইন। আর আইন মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য থাকবে স্বাধীন বিচার বিভাগ। আর তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার জন্য থাকবে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম।

আমি বোধ হয় ইউটোপিয়ার কথা বলছি। স্বপ্ন দেখছি। বাস্তবতা খুবই ভিন্ন। কিন্তু স্বপ্ন তো দেখে যেতেই হবে। স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতার জন্য অবিরাম লড়াই করে যাওয়া।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক