অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বনাম পরিবেশদূষণ

উইলিয়াম ডি নর্ডহাউস ও পল রোমার
উইলিয়াম ডি নর্ডহাউস ও পল রোমার

নোবেল পুরস্কারগুলোর মধ্যে অর্থনীতিতে নোবেল নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক আছে। মর্যাদার দিক থেকেও এটি অন্যান্য ক্ষেত্রের নোবেল পুরস্কারগুলোর সমকক্ষ নয়, শুধু শান্তিতে নোবেল ছাড়া। এর কারণ মূলত দুটো।

প্রথমত, ১৮৯৫ সালে আলফ্রেড নোবেলের ঠিক করে দেওয়া বিষয়গুলোর (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য ও শান্তি) মধ্যে অর্থনীতি ছিল না। ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার চালু হওয়ার ৬৭ বছর পরে এটির প্রবর্তন করে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক—সুইডিশ ন্যাশনাল ব্যাংক। ১৯৬৮ সালে তাদের ৩০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে প্রবর্তিত পুরস্কারটির অর্থায়ন হয় সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।

দ্বিতীয়ত, ৫০ বছর ধরে অর্থনীতির যেসব তত্ত্ব ও কাজ এই পুরস্কার পেয়ে এসেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই হয় বাস্তবতাবর্জিত, নয় বিভ্রান্তিকর।

তারপরও প্রতিবছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। তবে নিন্দা-সমালোচনার মুখে ইদানীং বাস্তব জগতের জটিলতা ব্যাখ্যা করায় বা সমস্যা সমাধানে তুলনামূলকভাবে বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক গবেষণা বা তত্ত্বকে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ রকম অবস্থার মধ্য দিয়েই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের ৫০ বছর পূর্ণ হলো ২০১৮ সালে। ১৯৬৯ সালে ডাচ অর্থনীতিবিদ ইয়ান টিনবারহেন ও নরওয়ের অর্থনীতিবিদ রাগনার ফ্রিশ প্রথম অর্থনীতিতে নোবেল পান। এ পর্যন্ত মোট ৮১ জন অর্থনীতিবিদ এই পুরস্কার পেয়েছেন। এ বছর পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম ডি নর্ডহাউস ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল রোমার।

উইলিয়াম নর্ডহাউস ১৯৭০ সালের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসনের সঙ্গে যৌথভাবে অর্থনীতির যে পাঠ্যবইটি লিখেছেন, সেটি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যপাঠ্য একটি বই। সে বিবেচনায় অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক পাঠ গ্রহণকারীদের কাছে তিনি পরিচিত একটি নাম, যদিও বইটি প্রথমে স্যামুয়েলসন একাই লিখেছিলেন। ১৯৮৫ সালে নর্ডহাউস এতে যুক্ত হন ও সম্পাদনা করেন। তবে পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডি ছাড়িয়ে নর্ডহাউসের কৃতিত্ব বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো পরিবেশের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করা। তিনি প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, প্রবৃদ্ধি ছাড়া বেশি মানুষের কাজের সুযোগ ও উন্নতি হবে না, সেটাও মেনেছেন। তবে লাগামহীনভাবে প্রবৃদ্ধির ঘোড়ায় চেপে বসলে প্রকৃতি ও পরিবেশের যে ক্ষতি হতে থাকে, তা জোর দিয়ে বলেছেন। এই ক্ষতি চলতে থাকলে তা একটা পর্যায়ে আবার প্রবৃদ্ধিকেই ব্যাহত করতে বাধ্য হয় বলে সতর্কও করেছেন। তিনি পরিবেশদূষণ ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতকে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয় বলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে তাঁর এসব কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে পল রোমার একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে বেশ কিছুদিন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৮০–এর দশক থেকে প্রবৃদ্ধির চালিকা বিষয়ে কাজ করছেন। তিনি সনাতনী তত্ত্বের বাইরে এসে দেখাচ্ছেন, প্রবৃদ্ধিতে প্রযুক্তি যে অবদান রাখে, তা একেবারে বিনা মূল্যে পাওয়া যায় না। প্রযুক্তি বা উন্নততর জ্ঞান তৈরি হয় বাজারের প্রয়োজন অনুসারে। তবে একবার তা তৈরি হয়ে গেলে সমাজে এর ব্যবহার প্রায় সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাই শুধু বাজারের প্রতিযোগিতার ওপর ছেড়ে দিয়ে নতুন প্রযুক্তি ও এর সুফল মেলে না। উদ্ভাবকেরা এর সঠিক মূল্য বাজার থেকে পান না। তাই সরকার তথা রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হয়—মানে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকে অর্থায়ন করতে হয়, উৎসাহিত করতে হয়, সুরক্ষা দিতে হয়। উৎসাহ ও সুরক্ষা যত জোরালো হবে, তত নতুন নতুন ধারণা তৈরি হবে। এসব নতুন ধারণা কিংবা উদ্ভাবন অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে। এ জন্য রোমার পেটেন্ট বা মেধাস্বত্ব¦ সংরক্ষণের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন। প্রবৃদ্ধির চালিকা হিসেবে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অবদানকে ভিন্ন মাত্রায় তুলে আনার কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে রোমারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদের চিন্তাভাবনা ও কাজের প্রধান মিলের ক্ষেত্রটি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। দুজনই প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। তবে নর্ডহাউসের চিন্তা এর প্রভাব বা ফল নিয়ে। আর রোমারের চিন্তা এর চালিকা নিয়ে। তাঁদের আরেকটি মিল হলো দুজনই বাজারশক্তির ওপর পুরোপুরি আস্থাবান নন। বাজার সব জানে—এমনটি তাঁরা বিশ্বাস করেন না।

বাংলাদেশের জন্য অর্থনীতিতে এবারের নোবেল পুরস্কারের বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ এখন উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ছুটছে। আর এটি করতে গিয়ে যেভাবে নদীদূষণ ও বায়ুদূষণ হচ্ছে এবং মাটির উর্বরতা নাশ থেকে সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তার পরিণতি যে সুখকর হবে না। যেমন, পোশাক কারখানাগুলো একদিকে বিশ্ববাজার থেকে রপ্তানি আয় এনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে, অন্যদিকে এসব কারখানার বিপুল বর্জ্য দেশের নদীনালা দূষিত করছে।

গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এনভায়রনমেন্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্সে (ইপিআই) বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম। অর্থাৎ, পরিবেশদূষণ রোধে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে শুধু বুরুন্ডি। এভাবে নর্ডহাউসের কথা সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। তিনি যে কার্বন কর আরোপ করতে বলেছেন, তা তো পরিবেশ ক্ষয়কারী কর্মকাণ্ডকে ব্যয়বহুল করার জন্যই।

সুতরাং, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও দূষণরোধে কীভাবে প্রবৃদ্ধিকে সমন্বয় করতে হবে, তা ভাবা খুব জরুরি। এখানে চলে আসে পল রোমারের চিন্তা। সুপ্রযুক্তি ও গবেষণা পারে এই সমন্বয় ঘটাতে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এমন হওয়া প্রয়োজন, যেখানে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়োজন ও দেশজ পরিপ্রেক্ষিত গুরুত্ব পাবে। এ কাজে রাষ্ট্রকেই দিতে হবে উৎসাহ এবং তা সঠিক ক্ষেত্রে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও শোভন কর্মসংস্থানের জন্য স্থানীয় উদ্ভাবন এমন হওয়া প্রয়োজন যেন বেশিসংখ্যক মানুষ কাজ করে ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, আর কাজগুলো পরিবেশের জন্য অধিক ক্ষতির কারণ না হয়।

আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিক