'একটা হুইলচেয়ার কি পাওয়া যাবে?'

‘একটা হুইলচেয়ার কি পাওয়া যাবে?’ এ রকম আকুল আবেদন শুনে ফিরে তাকাই। একজন প্রতিবন্ধী নারী। জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ। হাঁটতে পারেন না। মফস্বলের এক সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার আশায় এসে বিপদে পড়েছেন। সঙ্গে কেউ নেই। এ রকম ঘটনা গ্রামগঞ্জে কম না। তাঁদের কথা কে ভাববে?

ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অবশ্য হুইলচেয়ার আছে। প্রতিবন্ধীদের সেবার বিশেষ ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু চলাফেরায় যাদের খুব সমস্যা, তাদের জন্য গণপরিবহন বলতে কিছুই নেই। যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাদের তো আরও সমস্যা। সাদাছড়ির তোয়াক্কা কেউ করে না। ঠেলেঠুলে হয়তো বাসে উঠল। বসার ব্যবস্থাও হলো। কিন্তু এরই মধ্যে তাকে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। হয়তো নানা ছুতায় হেলপার বা কোনো যাত্রী সাহায্যের ছলে তার গায়ে হাত দিয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাই পথেঘাটে অপদস্থ হতে হয়।

সেদিন প্রথম আলোর উদ্যোগে এবং ডিজঅ্যাবলড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) ও সিবিএমের সহযোগিতায় এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিবন্ধীদের জন্য একীভূত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও সহযোগিতা
ছিল। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন প্রধান অতিথি।

এখানে ‘একীভূত’ কথাটির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ, প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম বা ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা উপজেলা সদরের হাসপাতালে জনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার মোটামুটি সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রতিবন্ধীদের সমান সুযোগ এখনো পুরোপুরি নেই। তাই আমরা একীভূত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ চাইছি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, সরকার প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য দুটি আইন পাস করেছে। বিশেষভাবে তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বাংলাদেশের কাজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

এটা নিশ্চয়ই আমাদের গর্বের বিষয়। আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ করছি। এটা আমাদের প্রতিশ্রুতি। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবায় প্রথম সারিতে চলে এসেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবা অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে।

দেশে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ প্রতিবন্ধী রয়েছে। তাদের সবার জন্য একীভূত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সহজ নয়। কিন্তু কয়েকটি পাইলট প্রকল্প পরিচালনার অভিজ্ঞতা বলছে, এটা সম্ভব। তবে বিশেষ উদ্যোগ দরকার।

এখানে সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকতে হবে। ডিআরআরএ এই সহযোগিতা নিয়ে মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলায় কাজ করছে। আলোচনায় তারা জানায়, ওই নয়টি উপজেলার সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চিকিৎসা ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সমাজের মূল স্রোতোধারায় পুনর্বাসিত করা সম্ভব। আটটি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স ও একটি সদর হাসপাতালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসেবা, ওষুধ, এমনকি অস্ত্রোপচারের সুযোগ পাচ্ছে।

এই মডেল অনুসরণ করে পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই প্রতিবন্ধীদের জন্য একীভূত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। এর ওপর জোর দিতে হবে।

কোনো এলাকায় প্রতিবন্ধীদের সঠিকভাবে শনাক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, অনেকে বুঝতেও পারেন না কে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বা কে অটিস্টিক। এটা নিশ্চিত করার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক থাকতে হবে। যেমন, একজন কথা বলতে পারে না। কারণ, তার জিহ্বায় সমস্যা রয়েছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক বুঝবেন যে তার জিহ্বায় একটি অপারেশন করা হলে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবে। পটিয়ার আলহাজ মনির আহমেদ চৌধুরী কমিউনিটি ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মো. নাসির উদ্দিন আলোচনায় অংশ নিয়ে জানালেন, এ রকম একজন রোগীকে জিহ্বায় অপারেশনের জন্য রেফার করা হয়। পরে তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে ফিরে এসেছেন। সারা দেশের প্রতিবন্ধীদের তালিকা থাকলে তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

আবার দেখুন, একজন ব্যক্তি শ্রবণপ্রতিবন্ধী এবং সে কারণে বাক্‌প্রতিবন্ধীও। সে হাসপাতালে গেছে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেখানে যদি ইশারা ভাষা জানা ব্যক্তি না থাকেন, তাহলে তো চিকিৎসা করাই সমস্যা। তাই সারা দেশে হাসপাতালের জন্য ইশারা ভাষায় দক্ষ প্যারামেডিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এখানে বলা দরকার, সন্তানসম্ভবা মায়ের নিয়ম অনুযায়ী শিশু জন্মের আগে ও পরে অন্তত তিনবার করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। প্রয়োজনীয় খাদ্য-পুষ্টি, শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না—সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখলে অনেক জটিলতা এড়ানো যায়। জন্মের পর যেন শিশুর কোনো সমস্যা না হয়, তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে আগে বা শিশুর জন্মের পর করা সম্ভব। আজকাল চিকিৎসাসেবায় অনেক উন্নতি হয়েছে। গ্রামে গ্রামে এই বার্তা নিয়ে যেতে হবে যে বাসায় নয়, কাছের হাসপাতালে শিশুর জন্মের ব্যবস্থা করলে অনেক জটিলতা কমে যায়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নবজাতকের প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়।

এখানে অবশ্য সরকারের আরও উদ্যোগী হয়ে প্রত্যন্ত এলাকার হাসপাতালগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন লেবার রুম ও ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসকের সুব্যবস্থা দরকার। জটিলতা দেখা দিলে যেন তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে প্রসূতিকে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও যেন থাকে। এখন অবশ্য কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। সারা দেশেই এটা দরকার।

শিশু যদি ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্মলাভ করে (প্রি-ম্যাচিউর), তাহলে জটিলতার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে শিশুর চোখ, কান বা অন্যান্য ইন্দ্রিয় ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। অবশ্যই সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসায় জটিলতা এড়ানো সম্ভব। সমাজের বিত্তবানেরা এ ধরনের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে পারেন। তাহলে অনেক পরিবারের সন্তান হয়তো প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

এখানেই আসে সামাজিক সহযোগিতার প্রশ্ন।

আমাদের আলোচনায় অংশ নিয়েছেন সাতক্ষীরার মনোয়ারা খাতুন। তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটা-চলাফেরায় সমস্যা। কিন্তু ডিআরআরএর সহযোগিতায় তিনি শুধু স্বাস্থ্যসেবাই পাননি, ক্রমে তিনি নিজে একজন সংগঠকও হয়েছেন। এলাকায় প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কাজ করছেন। নারীকণ্ঠ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। তিনি বাসে চলাফেরা করতে পারেন। এলাকার সব প্রতিবন্ধীকে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। তিনি বললেন, সমাজের বিভিন্ন কাজে প্রতিবন্ধীদের নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। এ জন্য তিনি কমিউনিটি সহযোগিতার ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেন।

প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতায় সরকার তো কাজ করবেই, সেই সঙ্গে সমাজের সবার এগিয়ে আসা দরকার।

সর্বাগ্রে দরকার প্রতিবন্ধীদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। এর জন্য টাকাপয়সা লাগে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও লাগে না। লাগে শুধু মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।

আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]