সড়ক টেকসই হয় না কেন

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বর্তমান সরকারের আমলে অনেক রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রাস্তাঘাট হয়েছে, ফলে সেসব অঞ্চলের মানুষ এতে অনেক উপকৃত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাস্তাগুলো নির্মাণের পর টিকছে কত দিন।

কিছুদিন আগে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর থেকে নাজিরপুর বাজারে যাওয়ার জন্য কোনো রিকশাওয়ালাকে রাজি করাতে পারিনি। কারণ, তাঁদের মতে রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অনেক কষ্টে এক অটোরিকশার চালককে রাজি করাতে পেরেছিলাম। অটোরিকশায় যেতে যেতে দেখলাম, রাস্তা সত্যিই খুব খারাপ: ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা। তিনি বললেন, সড়কটির এই দুরবস্থার একটা বড় কারণ অতিরিক্ত ওজনের ট্রাক চলাচল। এই সড়কে একেকটি ট্রাকে ৩০ টনের বেশি বালু বহন করা হয়। দিনে-রাতে এ রকম অজস্র ট্রাক চলাচল করে।

একই চিত্র দেখা গেছে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার শ্যামগঞ্জ থেকে সুসং দুর্গাপুর পর্যন্ত সড়কে। চার বছরের বেশি সময় ধরে এই আঞ্চলিক সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে। এটিকে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। ৩৬ দশমিক ৫৩ কিলোমিটারের এই সড়ক নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৬ কোটি টাকা। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করছেন, সড়কটি নির্মাণের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবাদে তাঁরা মানববন্ধনও করেছেন। আরও ক্ষতিকর বিষয় হলো সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই এর ওপর দিয়ে দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর বালু ও পাথরবাহী ট্রাক চলাচল শুরু হয়ে গেছে।

নেত্রকোনায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) একজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পরেও ৩০ টন ওজনের বালুবাহী ট্রাক চলাচল করলে সড়ক টিকবে না। জানতে চাইলাম, তাঁরা কেন অভিযোগ জানাচ্ছেন না। উত্তরে বললেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতি মাসে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভা হয়। সেখানে তাঁরা চারবার লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি।

সমন্বয় কমিটির এই সভায় জেলা প্রশাসক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জেলার পুলিশ সুপারসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের প্রধানেরা এই সভায় উপস্থিত থাকেন। অভিযোগের অনুলিপি তাঁরাও পেয়ে থাকেন। জেলার বিভিন্ন আসনের সাংসদেরা এই সভার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মানে দাঁড়ায়, সবাই এ বিষয়ে অবগত থাকার পরেও অতিরিক্ত ওজনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই রাস্তায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ ট্রাক চলাচল করে। তাঁদের ধারণা, প্রতিটি ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয়। স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে অনেক সরকারি কর্মকর্তাও এর ভাগ পান। সে জন্যই অতিরিক্ত ওজনের ট্রাক চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। বস্তুত সারা দেশের সড়ক–মহাসড়কগুলো দ্রুত ভেঙেচুরে যাওয়ার পেছনেও রয়েছে এসব কারণ।

গত বছর সওজ ও এলজিইডির কর্মকর্তারা বলেছেন, শুধু অতিরিক্ত ওজনবাহী যানবাহনের কারণে প্রতিবছর দুই হাজার কিলোমিটার সড়ক সংস্কার করতে হয়। অথচ সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যানবাহনের ওজনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে ২০১২ সালে সরকার এ–সংক্রান্ত ‘এক্সেল লোড নীতিমালা’ প্রণয়ন করে। কিন্তু মালিক–শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং মালিকদের চাপে গত বছর তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ট্রাকের ওজন বহনের সীমা ১৫ টন থেকে বাড়িয়ে ২২ টন করা হয়।

গত বছর বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাস্তাঘাট নির্মাণে বাংলাদেশের মতো এত ব্যয় পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। প্রতি কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণের খরচ ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন থেকে ১১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। অথচ ভারত ও চীনের মতো দেশেও এ খরচ ১ দশমিক ১ মিলিয়ন থেকে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। তাদের সড়ক–মহাসড়কগুলো আমাদের মতো দ্রুত ভেঙেচুরে যায় না। সড়ক নির্মাণে মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ওজনবাহী যানবাহনের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা দরকার।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সওজ আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা রাস্তাঘাটের নির্মাণ ও সংস্কারে অত্যধিক ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, এত অর্থ ব্যয় করে সড়ক নির্মাণের পর কিছুদিন না পেরোতেই তা ভেঙে যায়। দেশে এখন প্রায় ৪ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খারাপ। অথচ ৯ বছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। কিন্তু শক্ত নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না হলে বছরে বছরে জনগণের বিপুল অঙ্কের অর্থের নয়ছয় হতে থাকবে, সড়ক–মহাসড়কগুলোর দুর্দশা ঘুচবে না।

খলিলউল্লাহ্: প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
[email protected]