মাথা নিচু আঙুল বাঁকা স্মার্ট প্রজন্ম

প্রথমে নিচের খবরটা পড়ুন: 

‘সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন মোবাইল নিয়ে। ঘুমের বাইরে একটাই কাজ—মোবাইল স্ক্রলিং করা। ফলাফল, হাতের আঙুলগুলো বেঁকে গেছে।’ চীনা সংবাদমাধ্যম সাংহাইস্টের সূত্র ধরে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি ঘটেছে চীনের হুনান প্রদেশের চাংসাইতে। তবে ওই নারীর নাম প্রকাশ করা হয়নি। আঙুলগুলো বেঁকে যাওয়ার জন্য তাঁকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
চিকিৎসকেরা আঙুল বেঁকে যাওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তাঁরা বলছেন, ওই নারী ডান হাতে দিনের পর দিন ঘুম ছাড়া বাকি সময় মোবাইল স্ক্রলিং করতেন। তিনি এতটাই নিবিড়তার সঙ্গে স্ক্রলিং করতেন যে তাঁর বুড়ো আঙুল ছাড়া বাকি আঙুলগুলো একদম স্থির থাকত।
চিকিৎসকদের মতে, নড়চড় ছাড়া আঙুলের এমন ব্যবহারের কারণে সেখানে রস ও রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে একপর্যায়ে আঙুলগুলো অসাড় হয়ে যায়। তাঁর ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথাও অনুভব হয়।
ওই নারী আপাতত সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকেরা বলছেন, তিনি সুস্থ হলেও আশা করছেন কেউ একনাগাড়ে এভাবে গ্যাজেট ব্যবহার করবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, আঙুল বেঁকে যাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এটা প্রথম আলোর ২৩ অক্টোবরের খবর। কিন্তু প্রথম আলো নিজে এই খবর তৈরি করেনি। সাংহাইস্ট থেকে এনডিটিভি হয়ে এই খবর এসেছে।
আমি এই খবর বিশ্বাস করিনি।
কারণ, ব্যবহারের ফলে যদি আঙুল বা হাতের ওপরে কোনো প্রভাব পড়ে, তাহলে বাঙালির আঙুল বহু আগেই বাঁকা হয়ে যেত। আঙুল জিনিসটা আমরা ব্যবহার করি ছিদ্রান্বেষণের জন্য। এবং অন্যের ত্রুটি পাই বা না পাই, আঙুলটা ব্যবহার করে ফেলি। বহু বছর আঙুল বাঁকা করে রেখেও যখন আমাদের সবাই বাঁকা আঙুল নিয়েই জন্মাচ্ছি না, কাজেই শুধু টাচফোন ব্যবহারের ফলে আঙুল বেঁকে যেতে পারে বলে মনে হয় না। আবার হতেও পারে। চীনে হয় না এমন কিছুই কি জগতে আছে!
চীনা নারীর আঙুল বেঁকে গেছে কি যায়নি, এই নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন আছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের এই খবরটার সত্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। খবরটা হলো ইংল্যান্ডে এক গবেষণা শেষে চিকিৎসকেরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত টাচস্ক্রিন ব্যবহার করায় শিশুরা আর পেনসিল ঠিকভাবে ধরতে পারছে না। কারণ, তাদের হাতের পেশি ঠিকভাবে গঠিত হচ্ছে না। গবেষণাটা করেছে হার্ট অব ইংল্যান্ড ফাউন্ডেশন এনএইচএস।
আমার নিজের ধারণা, আজ থেকে ২০ বছর পরে স্কুলে কোনো বাচ্চাকে আর হাতের লেখা লিখতে হবে না। তারা কি-বোর্ডে টাইপ করে লিখবে। তাদের আর হাতের লেখা জমা দিতে হবে না। কি-বোর্ডে টাইপ করে লিখে তারা ই-মেইল করে শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দেবে। তারা স্বাক্ষরও করবে না। হাতের আঙুলের ছাপ দেবে। আর তারা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা শিখবে। তাতে ভালো হবে না খারাপ হবে, তা অবশ্য আমার জানা নেই।
আমাদের বাংলা পাঠ্যপুস্তকে একটা প্রবন্ধ ছিল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র লেখা—ভবিষ্যতের মানুষ। তাতে তিনি বলেছিলেন, গতস্য শোচনা নাস্তি, অতীত নিয়ে শোচনা করে কোনো লাভ নেই। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ। ভবিষ্যতের মানুষ খাবে না, শুধু প্রয়োজনীয় ক্যালরি, ভিটামিন, মিনারেলস ইত্যাদির ক্যাপসুল খাবে; কাজ করবে না, শুধু আঙুল দিয়ে বোতাম টিপবে; আর শুধু ভাববে। কাজেই তার শুধু থাকবে মাথা, বিশাল গোলমাথা, পেট থাকবে না, তারা হাঁটবে না, কাজেই তাদের পা থাকবে না, থাকবে কতগুলো হাতের আঙুল।
ওপরের দুটো খবর পড়ে আমার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটার কথাই মনে পড়ছে। আমরা কি সেই যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি? যেখানে আমাদের থাকবে শুধু মাথা আর হাতের আঙুল?
তবে বাঙালির জিব কিন্তু থাকবে। বাঙালির আর কিছু না থাকুক, কথার বহর কিন্তু কমছে না।
স্মার্টফোন নাকি একটা মাথানিচু প্রজন্ম তৈরি করছে। তারা সারাক্ষণ মাথা নিচু করে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
১৬ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মেরুদণ্ড দিবস। আমি একটা থেরাপি সেন্টারে যাই ব্যথার চিকিৎসা নিতে। ওঁরা বলে দিয়েছিলেন, আপনারা ১৬ অক্টোবরে আসবেন, আমরা থেরাপি দেব, তবে আপনাদের সঙ্গে করে আনতে হবে একটা জিনিস। আর তা হলো মেরুদণ্ড।
আমি ভাবছি, আমরা কি থেরাপি সেন্টারে যেতে পারব? আমাদের কারোরও কি আর মেরুদণ্ড আছে?
আমরা তো সব কেঁচো হয়ে যাচ্ছি। অমেরুদণ্ডী প্রাণী।
বিবর্তন যে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, জানি না। মেরুদণ্ড লোপ পেলে অবশ্য ভালোই। মেরুদণ্ডের ব্যথা থাকবে না।
ব্যাকপেইন আর নেকপেইন নিয়ে বড় পেরেশান হয়ে আছি।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক