সেলাই দিদিমণিদের বিবর্ণ জীবন

রোজ সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে রাস্তার দুপাশে হেঁটে চলেছেন শত শত নারী পোশাকশ্রমিক। বেশির ভাগেরই পরনে সস্তা সালোয়ার-কামিজ কিংবা শাড়ি। কারও কারও সঙ্গে বিবর্ণ ব্যাগ। বিশ্ববাসীকে সুন্দর পোশাকে সাজানোর কাজে এই নারী শ্রমিকদের বাস্তব জীবনের খবর আমরা কজন রাখি? ব্যান্ড সংগীতশিল্পী জেমস তাঁর গানে এঁদের সম্বোধন করেছিলেন ‘সেলাই দিদিমণি’ বলে। সেলাই দিদিমণিরা কোন জাদুমন্ত্রবলে দৃপ্ত পায়ে রোজ ছুটে চলেন পোশাক কারখানায়?

ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকার প্রায় আড়াই হাজার পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ওপর আইসিডিডিআরবির এক সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য হলো ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী শ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের সাফল্য বিরাট। গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, এই শিল্প খাতে কর্মরত আছেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, তাঁদের ৬৫ শতাংশই নারী। তাঁরা সংখ্যায় প্রায় ২৬ লাখ। এতে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ২১ লাখই ভুগছেন রক্তস্বল্পতায়। এটা কি আমাদের বিবেককে একটুও নাড়া দেয় না?

বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা অন্যান্য দেশের শ্রমিকের তুলনায় সবচেয়ে কম মজুরি পান। ভিয়েতনাম, চীন, ফিলিপাইন ও ভারতের শ্রমিকেরা যথাক্রমে জীবনধারণের উপযোগী মজুরির ৩৯, ৩৪, ৩২ ও ২৭ শতাংশ পান, কিন্তু বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা পান মাত্র ১৪ শতাংশ। সম্প্রতি পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৫ হাজার ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। এটা আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর হবে বলা হয়েছে। কিন্তু ৮ হাজার টাকা মজুরিতে আমাদের নারী পোশাকশ্রমিকদের রক্তাল্পতা দূর হবে?

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরিবৈষম্যসহ নানা ধরনের বঞ্চনা, দুর্দশা আছে। তবে নারী শ্রমিকের বৈষম্য ও বঞ্চনা অপেক্ষাকৃত বেশি। মজুরিবৈষম্য ছাড়াও নারী পোশাকশ্রমিকেরা কারখানার ভেতরে ও বাইরে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক সমীক্ষাধর্মী গবেষণায় পাওয়া তথ্য হলো, প্রায় ১৪ শতাংশ নারী পোশাকশ্রমিক কারখানার ভেতরে এবং ১৯ শতাংশ কারখানার বাইরে ও আসা-যাওয়ার পথে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। অধিকাংশ নারী শ্রমিকই নিয়োগপত্র পান না, ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়া পারিবারিক নির্যাতনের শিকারও হন অনেকে। অনেকের নিজের আয়ের ওপর কর্তৃত্ব নেই। আয়–ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রেখে পুরো পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। পরিবারের ব্যয় সংকোচনের ক্ষেত্রে সেই চিরচেনা ভূমিকাতেই বারবার অবতীর্ণ হয় নারী। পরিবারের নানা ব্যয়ভার মেটাতে একজন নারী সমঝোতা করেন নিজের পুষ্টির চাহিদা কিংবা নিজের সাধ-আহ্লাদের সঙ্গে। অনেকে অসচেতনতার কারণে নিজের পুষ্টির চাহিদা সম্পর্কে অমনোযোগী।

তবু বাংলাদেশের নারী পোশাকশ্রমিকেরা থেমে নেই। নিত্যদিনের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতাসহ শারীরিক নানা ধরনের রোগব্যাধি; সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েও তাঁরা শ্রম দিয়ে চলেছেন। তাঁরা নিজেরাই হয়তো জানেন না কীভাবে তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে উর্বর রাখতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁদের এই দৃঢ়তা এবং অনমনীয়তা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ। কিন্তু আমরা কতটুকু স্বীকৃতি দিই তাঁদের এই অবদানের? এই শিল্পে দিন দিন কমে যাচ্ছে নারী শ্রমিকের সংখ্যা। আগে যেখানে পোশাকশিল্পে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক ছিলেন, এখন তা কমে হয়েছে ৬১ শতাংশ। দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর নানা ধরনের নির্যাতনে জর্জরিত এসব নারী শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। দেশের পণ্য রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে এবং এখনো এই খাতের সিংহভাগ শ্রমিক নারী।

নিজের ও পরিবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এ দেশের পোশাকশ্রমিকের ৬২ শতাংশই দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রম দেন। তাঁদের মজুরি অবশ্যই আরও বাড়ানো উচিত; বছরে বছরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে হালনাগাদ করা উচিত। সর্বোপরি নারী শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তনে শুধু নতুন মজুরিকাঠামোই যথেষ্ট নয়, বরং তাঁদের নানামুখী সমস্যা সমাধানে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক