উন্নয়ন চাই, গণতন্ত্রও চাই

গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা আগের চেয়ে হ্রাস পাওয়া শুরু করে। এই সময়টাতে কিছু দেশের শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের অতি শিথিল সংজ্ঞাতেও আর অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে এই সময়টাতে ঘন ঘন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে। মিসরে জামাল আবদেল নাসের, সিরিয়ায় হাফিজ আল আসাদ, ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণ, পাকিস্তানে আইয়ুব খান, দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্ক চুং হি, ফিলিপাইনে ফার্দিনান্দ মার্কোস, মিয়ানমারে নে উইন, আর্জেন্টিনায় জুয়ান পেরন, চিলিতে আগুস্তো পিনোশে, যুগোস্লাভিয়ায় মার্শাল টিটো, উগান্ডায় ইদি আমিন, সোমালিয়ায় সাইদ বারে, নাইজেরিয়ায় সানি আবাছা, স্পেনে ফ্রান্সিস ফ্রাংকো রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসেন। তাঁদের মতো আরও অনেক সামরিক-অসামরিক একনায়ক নিজ দেশের মানুষকে বুঝিয়েছেন, গণতন্ত্রের আগে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ দরকার।

ওই সময়ে নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি দেশ শিথিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু রাখে। কিন্তু কালক্রমে সেসব দেশে আমলাতন্ত্রের কাজকারবার এতই জটিল ও দুর্নীতিযুক্ত হয়ে পড়েছিল যে মানুষের মনে হতে থাকে—গণতন্ত্রই বোধ হয় দেশে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের পথে বাধা। তখন উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার নামে সেখানেও একনায়কত্ব জেঁকে বসে এবং জনগণের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সংকুচিত করতে থাকে। আফ্রিকার বহু দেশে এখনো অনেক একনায়ক উন্নয়নের কথা বলে গদি আঁকড়ে রেখেছেন। সম্প্রতি ইথিওপিয়া ও জিম্বাবুয়েতে দৃশ্যপট বদলেছে।

আরব মুসলিম দেশগুলোতে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও বংশতন্ত্রের নামে বাদশাহ-আমিররা একদিকে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব করেছেন; অন্যদিকে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। লাতিন আমেরিকায় আছে জনতুষ্টিবাদী নেতাশাসিত একাধিক দেশ। এসব শাসক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার কথা বলে নিজেদের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব দেশে যে একেবারেই উন্নয়ন হয়নি, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো দেশ, যেমন কোরিয়া যথাযথ উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেলেও বেশির ভাগ দেশে যত না অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তার তুলনায় ক্ষমতাসীনেরা অনেক বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন।

ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতা বলছে, বহু দেশেই নির্বাচিত সরকার আসলে বিধিবিধান ও স্বচ্ছতার আড়ালে একনায়কতান্ত্রিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকার। পারস্পরিক আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় কর্মী-নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এ সরকারগুলো টিকে আছে। এ ধরনের সরকারগুলো ৩৩ শতাংশ গণতান্ত্রিক, ৩৩ শতাংশ প্রভুত্ববাদী এবং বাকি ৩৪ শতাংশ স্বৈরতান্ত্রিক। এর মূল কারণ, সংবিধানের কাঠামোগত দুর্বলতা, ক্ষমতার পৃথকায়নে অস্পষ্টতা ও প্রতিবিধায়ক ভারসাম্য না থাকা।

আবার নির্বাচিত বা অনির্বাচিত স্বৈর সরকার যখন মানবাধিকার, জননিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণ শাসকগোষ্ঠীকে ঘন ঘন বদলাতে প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলানো সত্ত্বেও যখন কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে না, তখন আবার মানুষ গণতন্ত্রে ছাড় দিয়ে উন্নয়ন, শান্তি, স্থিতি ও নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে অনির্বাচিত বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন দেয়। স্বৈরতান্ত্রিক গোষ্ঠী ওই সুযোগে একধরনের নব্য গণতন্ত্রের বুলি শুনিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় দেশ চালাতে থাকে। তাতে জনগণ অল্প কিছুকালের জন্য থমকে দাঁড়ায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেমে থাকে না।

এ অবস্থায় কোনো দেশের জন্য যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন আবশ্যক, তা আগে হবে, নাকি গণতন্ত্র আগে আসবে—সেই বিতর্ক সামনে আসে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই যে ‘উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র পূর্বশর্ত’। এর কারণ বা ব্যাখ্যা যেমন দুষ্কর, তেমনি এ ব্যাপারে উপসংহার টানাও কঠিন। বিষয়টি এখনো নিশ্চিতভাবে অমীমাংসিত।

তবে আমরা এখন সত্যিকার অর্থেই বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে মৌলিক পরিবর্তন দেখছি। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কারণে গণতান্ত্রিক মতাদর্শের দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। তবে সেখানে একটা কারণ অভিন্ন—তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার। তথ্যবিপ্লবের ফলে স্বৈরশাসক বা একনায়কদের পক্ষে ‘ব্যক্তির সার্বভৌম স্বাধীনতার সংক্রামক ধ্যানধারণা’ থেকে সাধারণ নাগরিকদের বিচ্ছিন্ন রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সাধারণ মানুষকে এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই। কোনো সরকারের হাতে এমন কোনো হাতিয়ার নেই যে এগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। এসব প্রযুক্তি সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও সেন্সর এড়িয়ে চলতে সক্ষম বিধায়, এগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেও শক্তিশালী করেছে। বছর কয়েক আগের ‘আরব বসন্ত’ এর দৃষ্টান্ত। এখন দেশে দেশে আন্দোলনকারীরা তথ্য আদান-প্রদানে ই-মেইল, টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যাঁরা বয়স্ক ও কম্পিউটারে শিক্ষিত নন, তাঁদের জন্য টিভি ও সংবাদপত্র যথেষ্ট সহায়ক। তাই দিন দিন স্বৈরশাসকদের পক্ষে তথ্যপ্রবাহের গতিরোধ বা নাগরিক কণ্ঠরোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

গণতন্ত্রায়ণের পথে অগ্রযাত্রার আরেকটি বড় কারণ হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনমান উন্নত করার জন্য সাধারণ মানুষের অপ্রতিরোধ্য অভিলাষ। জেফারসন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দার্শনিক সম্ভবত এ ধারণা পোষণ করেছিলেন যে দৈনন্দিন জীবনে বহুমাত্রিক প্রযুক্তির নৈমিত্তিক ব্যবহারের ফলে যে পার্থিব সম্পদ সৃষ্টি হবে, তা যথাযথ বিলিবণ্টনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এবং সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটবে। মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা ও সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক মনোভাবের মধ্যে গভীর যোগসূত্র আছে। জেফারসন জোর দিয়ে বলেছেন, মধ্যবিত্ত মানুষের অভিপ্রায়, আবেগ-অনুভূতিকে যদি দীর্ঘকাল অস্বীকার করা হয়, তাহলে সমতা ও জনসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতাকে নির্জীব করে দিয়ে তারাই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।

বহু দেশ, বিশেষ করে, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রার আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মধ্যবিত্ত সমাজের আবির্ভাব ঘটেছে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে একই ঘটনা ঘটেছে। জেফারসন তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে হয়তো আগাম বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণিই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনব্যবস্থার অবসান দাবি করবে।’ একুশ শতকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনব্যবস্থা বলতে বোঝানো হয়েছে, সামরিক শাসকগোষ্ঠী, একদলীয় শাসন বা একনায়কত্ব, নির্বাচিত সরকার কিন্তু স্বৈরাচারী কায়দায় শাসন, কিংবা নিজ মহিমায় জনগণকে মোহগ্রস্ত রেখে একক নেতার ব্যক্তিগত স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। এসব দেশের সেরা দৃষ্টান্ত হচ্ছে: জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, বাংলাদেশ, চিলি, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো।

তবে প্রকৃত পরিমাপে কোনো শাসনব্যবস্থাই নিখুঁত নয়, কোনো সরকারই গণতান্ত্রিক নয়। কারণ, গণতন্ত্র মাত্রার বিষয়। তবে জনগণের সম্মতিতে সরকার গঠন, তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা, নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি, ক্ষমতার পৃথকায়ন ও ভারসাম্য সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের ওপর নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ—এগুলো উদার গণতন্ত্রের মূল নির্যাস।

বাংলাদেশে কী হয়েছে? সত্তরের দশকের তুলনায় আশির দশকে জীবনমানের সামান্য একটু উন্নয়ন হয়েছিল। শিক্ষা একটু বেড়েছিল। মধ্যবিত্তের অবস্থান কিছুটা শক্ত হয়েছিল এবং তারা শক্তভাবে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল। সেখান থেকে জনজোয়ার সৃষ্টি হলো। ফলে আমরা একবার গণতন্ত্র আনতে পেরেছি। কিন্তু সেখান থেকে আমরা পিছিয়ে গেছি। সে গণতন্ত্রকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা অবিনাশী। কারণ, এর সঙ্গে ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা যুক্ত। প্রকৃতিপ্রদত্ত উন্মুক্ত শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক পরিসরের সংকোচন মানুষ লম্বা সময় মেনে নিতে পারে না। তাই মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে কখনো জেল-জুলুম মানতে পারেনি। আমিও পারি না। আমি গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সমানতালে চাই। যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তাকে টেকসই করতেই এখন গণতন্ত্র অপরিহার্য। এ সুযোগ বন্ধ থাকলে যে উদ্যোগ, উদ্যম সৃষ্টি হয়েছে, তা একসময় ঝিমিয়ে পড়বে, দীর্ঘ সময়ে থেমে যাবে। তাই দ্রুতই জনগণের বৃহৎ বঞ্চিত, নিষ্পেষিত অংশকে স্বাভাবিক জীবন ও কর্মধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এর জন্য এখন আমাদের আত্মার উন্নয়ন দরকার।

আবদুল আউয়াল মিন্টু এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি