পুত্রদায়ে ভারাক্রান্ত পিতাদের কথা

পুত্রের মুখ না দেখা পর্যন্ত জীবনের কোনো মানে খুঁজে না পাওয়া মানুষের সংখ্যা এ দেশে কম নয়। অবিভক্ত বাংলার এক মুখ্যমন্ত্রী পুত্রসন্তানের মুখ দেখার জন্য তিন–তিনটা বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিলেন। কিন্তু পুত্রটির গুণগান করার কোনো মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। মুখ্যমন্ত্রী বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিও পুত্রের আচরণে মূক হয়ে যেতেন। সিরাজগঞ্জের হাজি ওসমানেরও মন পুত্রসন্তানের জন্য আকুলি–বিকুলি করত। পাঁচ কন্যার পর তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। তাড়াশ উপজেলার দীঘিসাগুনা গ্রামের হাজি ওসমান প্রামাণিকের জমিজমা পাঁচ মেয়ের বিয়ে, নিজের হজের খরচ আর বংশের বাতি একমাত্র পুত্রধন ফারুক প্রামাণিকের পড়ার খরচ চালাতে হাতছাড়া হয়। সেই ছেলে ফারুককে তিনি উকিল বানিয়েছেন। তাঁরই লাঠির আঘাতে ওসমান হাজির জীবন গেল। ২৫ অক্টোবর ফারুক তাঁর বাবাকে লাঠি দিয়ে শেষবারের মতো পেটানোর আগেও অনেকবার শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনের কথা প্রতিবেশীরা পুলিশকে জানিয়েছেন। এই তাড়াশেরই কাজিপুর গ্রামে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি আরেক পিতা প্রাণ হারান পুত্রের লাঠির আঘাতে।

পিতৃঘাতী পুত্রগণ
মাত্র মাস দুয়েক আগে (২৯ জুলাই, ২০১৮) কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে আরেক পিতার প্রাণ যায় ছেলের লাঠির আঘাতে। গত বছর (২৭ মে ২০১৭) নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার দক্ষিণ কারারচর গ্রামে পিতা-পুত্রের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে পুত্রের লাঠির আঘাতে পিতা নিহত হন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কানাইডাঙ্গা গ্রামের পিতা নজরুল ইসলাম পুত্রের লাঠির আঘাতে মারা যান ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তালিকা এখানেই শেষ নয়। এ পর্যন্ত তালিকা দেখে মনে হতে পারে, এসব গ্রামের কাহিনি, বিদগ্ধ শহরে এসবের বালাই নেই। খোদ রাজধানীতেই পুত্রের হাতে পিতা খুন হওয়ার একাধিক ঘটনা পাঠকের মনে থাকার কথা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব খুনকে নেহাত দুর্ঘটনা বা মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা মাদকাসক্ত পুত্রের কাজ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

শুধু যে পিতা খুন হচ্ছেন তা–ই নয়, মায়েরাও মরছেন গুণধর ছেলেদের হাতে। কখনো পিতা–পুত্রের কাইজা মেটাতে গিয়ে পুত্রের লাঠির আঘাতে, কখনো পুত্র–পুত্রবধূর মধ্যে হাতাহাতি থামাতে গিয়ে তাঁরা মারা পড়ছেন। চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের খামপাড় গ্রামে পুত্রের লাঠির আঘাতে এভাবে প্রাণ গেল এক মায়ের। এই তালিকাও যথেষ্ট দীর্ঘ।

গুণধরেরা যে সব সময় গায়ে হাত তুলে পিতাকে হাপিশ করে দিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। গুণধর সন্তানেরা তাঁদের নানা অপকর্ম আর অর্বাচীন পদক্ষেপের মাধ্যমে পিতা–মাতার নাম ডুবিয়ে তাঁদের বারোটা বাজাচ্ছেন চারদিকে। সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের সুনামের সাদা কাপড়ে কাদা ছিটিয়ে চলেছিলেন তাঁর প্রায় ঘোষিত উত্তরসূরি পুত্র বাসিল আল আসাদ। তাঁর বেআইনি প্রভাব প্রতিপত্তি একসময় এতটায় বেড়ে গিয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদকে মানুষ হাফিজ বা প্রেসিডেন্ট নয়, বরং ‘আবু বাসিল’ বা বাসিলের বাবা বলে ডাকতে শুরু করেন। গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর হঠাৎ মৃত্যু না হলে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের নাম কেউ জানত না। এরপর সাদ্দামপুত্র, গাদ্দাফিপুত্র, হোসনি মুবারকপুত্র, কোনো পুত্রের দাদাগিরি দেখা বাকি ছিল না। সম্প্রতি দিল্লিতে জনৈক সাংসদপুত্রের খোলা পিস্তল হাতে এক দম্পতির সঙ্গে বচসায় লিপ্ত হওয়ার লাইভচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র, ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রীর পুত্র আর এখন বিজেপি সভাপতির পুত্রের দাদাগিরির খবর মানুষের মুখে মুখে। তবে শুধু পুত্র নয়, জামাইও বিড়ম্বনা হয় বটে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের জামাতার কীর্তি কম নয়। এ দেশে কোনো এক কন্যাদায়গ্রস্ত সম্পাদকের জামাতার জাঁতায় পিষ্ট হয়ে নিরীহ সম্পাদকের গুষ্ঠি উদ্ধার করেছেন অনেকেই। এখন আরব বদ্বীপের আরেক শাহজাদা পুত্র নিয়ে সারা পৃথিবীর ঘুম টুটে গেছে, যেন এক কঠিন ইনসমনিয়া শুরু হয়েছে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে। বলা হয় পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। তবে জীবিত পুত্ররাও অনেক সময় তার চেয়েও ভারী বস্তুতে পরিণত হতে পারে যদি না পিতা–মাতারা সময়মতো লাগামটা টেনে না ধরেন।

তবে দুরাচার পুত্রদের পক্ষেই থেকে যান পিতারা
যেসব পিতা–মাতা গুণধর পুত্রের হাতে মারা পড়েছেন, তাঁরা যদি হত্যা প্রচেষ্টার পর মারা না যেতেন, যদি হাসপাতালে নেওয়ার পর কোনো অলৌকিক কারণে বেঁচে যেতেন, তাহলে কি তাঁরা মামলা চালাতেন? পুত্রের শাস্তি দেখতে চাইতেন? নাকি গুণধর পুত্রের পক্ষে সাফাই গাইতেন, তাকে আইনের বেড়ির বাইরে আনার জন্য যা করার তা–ই করতেন? পুত্রের হাতে নিগৃহীত এক পিতা পুলিশের কাছে মুখ খুলতে নারাজ হয়েছেন সম্প্রতি। উল্টো তদবিরে তৎপর হয়েছেন। ইতিহাস বলে হজরত নুহ (আ.) তাঁর নিজের অবাধ্য পুত্রের জন্য আল্লাহর কাছে পর্যন্ত তদবির করেছিলেন।

পৃথিবীর ঘুম হারাম করা খাসোগি হত্যার দায় থেকে পুত্রকে বাঁচানোর চেষ্টায় এখন সব থেকে বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌদি বাদশাহর। একের পর এক খুনের বয়ান পরিবর্তিত হচ্ছে। সত্যের চেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে পুত্র, জামাতা, দৌহিত্ররা। এখানে–সেখানে সবখানে।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণকর্মী ও গবেষক।