সফল না নিষ্ফল সংলাপ?

সড়ক পরিবহন ধর্মঘটে পোড়া মবিলের উৎকট গন্ধের রেশ না যেতেই সংলাপের সৌরভে এখন রাজনৈতিক অঙ্গন বিমোহিত। সর্বত্র এখন সংলাপ নিয়ে আলোচনা। কদিন আগেও কেউ ভাবতে পারেননি যে চির বৈরী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা একসঙ্গে বসবেন। তবে সরকারি দল বলতে পারে তারা বিএনপির সঙ্গে বসছে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করছে।

কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে যে ১৬জন প্রতিনিধির নাম পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচজন বিএনপির নেতা। পরবর্তী পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বিকল্প ধারা বাংলাদেশ-এর নেতা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ অন্যদের সঙ্গে বসবেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। সংলাপে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

সংলাপ শুরু হওয়ার আগেই এর উদ্দেশ্য ও ফল নিয়ে নানা মহলে সরগরম আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, সংলাপটি লোক দেখানো। সরকার নিজের ছক মতোই নির্বাচন করবে। কারও মতে, সরকার দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বকে দেখাতে চাইছে যে তাঁরা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনে আগ্রহী। পরপর দুবার নির্বাচনে আসা না আসা বিএনপির বিষয়। এ ছাড়া আরও একটি মত রয়েছে, বর্তমান অবস্থা ও ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে ‘নেতৃত্বহীন’ বিএনপি খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগই জয়ী হবে। কেননা বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে জেলে, বিকল্প নেতা তারেক রহমান বিদেশে। পরের পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাও সম্প্রতি আটক হয়েছেন।

সরকারি দলের নেতারা বরাবর বলে আসছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। তবে এখন বলছেন বিরোধী দল তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এখন দেখা যাক বিরোধী দলের সাত দফায় কী আছে। এতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় সংসদ বাতিল না হলেও এখন আর এর কার্যকারিতা নেই, যদিও সাংসদেরা পদে বহাল থাকবেন। কিন্তু বর্তমান সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করার যে দাবি বিরোধী দল করছে, সেটি পূরণ করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। কে করবে সেই পরিবর্তন? ১৯৯৬ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সেই পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এখন সে রকম কোনো পরিস্থিতি আছে কি?

তবে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে সংবিধান পরিবর্তন না করেও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার আলোকে সব দলের প্রতিনিধি নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে। বিএনপি সংসদে না থাকলেও টেকনোক্র্যাট কোটায় ৩০ জনের মন্ত্রিসভায় অন্তত তিনজন সদস্য নেওয়া যেতে পা্রে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীও সে রকম একটি প্রস্তাব অনেক আগে দিয়েছিলেন।

আর সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার কথা শুধু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বলেনি। বিকল্প ধারা ও বাম গণতান্ত্রিক জোটও একই প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বিরোধীরাসহ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের যে প্রস্তাব ঐক্যফ্রন্ট দিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে সেটি সম্ভব নয় বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যে বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সকল রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনী মাঠের সমতা নিশ্চিত করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যাবে না। যেকোনো দেশে নির্বাচনকে অবাধ, ও সুষ্ঠু করতে এগুলো জরুরি বলে মনে করি। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতেও এসব কথা বলে এসেছে এবং একাধিকবার সেই দাবি আদায় করেই নির্বাচন করেছে।

এসব মৌলিক বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হলো অন্যান্য বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন নয় বলে মনে করি। সংবিধান অনুযায়ী তফসিলের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে চলে যায়। প্রশ্ন হলো কমিশন সেই এখতিয়ার প্রতিষ্ঠায় প্রস্তুত আছে কি না।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর জবাবে সরকার হয়তো যুক্তি দেখাবে আদালত খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিয়েছেন। আদালতের মাধ্যমে তাঁকে মুক্ত হতে হবে।

কোনো দলীয় প্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহীর এটাই প্রথম পত্র বিনিময় নয়। আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৯৪ সালে যখন তৎকালীন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাঁকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির ভাষা ছিল এরূপ:

‘আপনি আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন । আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে ১৯৯১ সালে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মেয়াদ খুব শিগগির শেষ হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সংবিধান অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশ ও জনগণের স্বার্থে আগামী নির্বাচনের আগেই চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব।’

১৯৯৫ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে তাঁদের মধ্যে তিন দফা চিঠি বিনিময় হয়। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রথম চিঠিটি লেখেন ২৮ অক্টোবর। এর আগেই অবশ্য জি-৫ নামে পরিচিত নাগরিকদের একটি দল দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। জি-৫-এর সদস্যরা ছিলেন যথাক্রমে বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, রেহমান সোবহান, ফখরুদ্দীন আহমদ ও ফয়েজ আহমদ। কিন্তু সেই সংলাপ ও মধ্যস্থতার উদ্যোগ সফল হয়নি। পরবর্তী সময়ে রাজপথে আন্দোলন করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা হয়েছিল। কিন্তু তিনটি নির্বাচনের পর সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাও বাতিল হয়ে গেছে। সংবিধান মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু ডঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক এবং এই জোটের প্রধান শরিক বিএনপি।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ড. কামাল হোসেনের লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যে সকল মহান আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের জনগণকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার অন্যতম হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে এবং জনগণকে শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনা করবে। এটাই আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার।’ আর প্রধানমন্ত্রী তার প্রত্যুত্তরে লিখেছেন, ‘সংবিধানসম্মত সব বিষয়ে’ আলোচনার জন্য তাঁর দ্বার উন্মুক্ত।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সংলাপের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন, যদিও সংলাপ বিষয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। একাধিকবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে সংলাপ হলেও ফলপ্রসূ হয়নি। ১০ম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়াকে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে সংলাপে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানালেও সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়। বিএনপি তখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে অনড় ছিল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন করে এবং পাঁচ বছর সরকারের মেয়াদও শেষ হওয়ার পথে। এবারে বিএনপি কিছুটা নমনীয়। নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাজনৈতিকভাবে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নেওয়াও কঠিন।

অনেকে বলেছেন, সংলাপ সফল হবে না। কোনো পক্ষ ছাড় দেবে না। আমরা মনে করি, তবু সংলাপ হোক। প্রতিপক্ষকে ‘দেখে নেওয়ার’ চেয়ে মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ মন্দ কি?

 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]