সহজে ব্যবসার সুযোগ

সহজে ব্যবসা করার সুযোগ বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। এটি এক ধাপ অগ্রগতি এ কারণে যে গত বছর এই সূচক ছিল ১৭৭, যা তার আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ নিচে। ১০০ নম্বরকে সর্বোত্তম ধরে এবার বাংলাদেশের নম্বর দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৯৭। আগের বছরে ছিল ৪১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। দেশটি ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ৮৬ দশমিক ৫৯। নিউজিল্যান্ডের পরে প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ১০০তম, ভুটান ৮১তম, নেপাল ১১০তম, মালদ্বীপ ১৩৯তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৬তম।

হতাশার দিক হলো, আগের বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। ভারত ২৩ ধাপ এগিয়ে ১০০ থেকে ৭৭তম স্থানে এসেছে। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও বাংলাদেশ থেকে ৯ ধাপ এগিয়ে রয়েছে। তাহলে সত্যিকারভাবে আমরা এগিয়েছি বলা যাবে না। ১০টি নির্দেশক বা মানদণ্ডে প্রতিবছর এ প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যবসা শুরু করা, নির্মাণকাজের অনুমোদন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র শেয়ারধারী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, দেউলিয়াত্ব ঠেকানো ও সীমান্ত বাণিজ্য ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশ বিদ্যুৎ-সংযোগ, সম্পত্তি নিবন্ধন ও কর প্রদান মানদণ্ডে উন্নতি করলেও অন্যান্য সূচকে পিছিয়ে রয়েছে।

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশ বিনিয়োগের আদর্শ স্থান বলে জোর গলায় প্রচার করে থাকেন। কেউ এটিকে ‘এশিয়ার নতুন ব্যাঘ্র’, কেউ ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বলে অভিহিত করেন। বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে বিদেশে রোড শো-ও করা হয়েছে একাধিকবার। বাংলাদেশে শ্রম যে অনেক সস্তা, তা-ও বিনিয়োগকারীদের অজানা নয়। তারপরও বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আসেনি বাধাগুলো দূর না হওয়ায়। নীতি-পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান অনেকটা সাফাই গেয়ে বলেছেন, গত বছর বিনিয়োগ সুবিধা বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো প্রতিবেদনে আসেনি। সেগুলো এলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ওপরের দিকে থাকত। প্রশ্ন হলো পদক্ষেপগুলো আগে নেওয়া হয়নি কেন? আগামী পাঁচ বছর নাগাদ বাংলাদেশের অবস্থান ১০০-এর মধ্যে আসবে বলে তিনি যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত না করেও বলতে পারি, তখন প্রতিযোগী দেশগুলো আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

আর্থসামাজিক অবস্থার দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সহজে ব্যবসা করার সুযোগের ক্ষেত্রে দেশটি এক বছরে ২৩ ধাপ এগোতে পারলে আমরা কেন তার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারছি না? ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিতে না পারি, কিন্তু আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও পিছিয়ে থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সমস্যা এড়িয়ে গেলে কিংবা যেটুকু এগিয়েছি তাতে সন্তুষ্ট থাকলে বাংলাদেশ কখনোই বিনিয়োগের আদর্শ স্থান হবে না। অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়ও টিকতে পারব না।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অপরিহার্য যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তার প্রতি জোর দিতে হবে। শুধু সস্তা শ্রম হলেই হবে না, অন্যান্য পূর্বশর্তও পূরণ করা জরুরি। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা মুখে বললেই হবে না, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে।