বিরোধী দল ছাড়া কি গণতন্ত্র হয়?

গণতন্ত্রকেও বাইসাইকেলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এর দুটো চাকা। একটা সরকার, আরেকটা বিরোধী দল। বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র চলে না। বিরোধী দলহীন শাসনকে আর যা–ই বলা যাক না কেন, গণতন্ত্র বলা যায় না। আমার এই তুলনায় আমি চালকের আসনে বসাব জনগণকে। গণতন্ত্র নামের বাইসাইকেলটার মালিক এবং চালক জনগণ। সরকার আর বিরোধী দল, এর দুটো চাকা। আর আইনস্টাইন যেটা জীবন সম্পর্কে বলেছিলেন যে ‘জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো, এটা সব সময় চালাতে হয়, তা না হলে থেমে যায়’, গণতন্ত্র সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য, গণতন্ত্রও বিরামহীনভাবে চর্চা করতে হয়, তা না হলে গণতন্ত্রও থেমে যায়।

বিরোধী দলের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর শেখ মুজিব গিয়েছিলেন করাচিতে, দেখা করেছিলেন তখনকার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে।

শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আমি তাঁকে বললাম যে, “আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি।’”

বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না, এটা বঙ্গবন্ধুর উক্তি। সারা পৃথিবীতে সবাই এটা একবাক্যে স্বীকার করেন। বিরোধী দলের কাজ সরকারকে পাহারা দিয়ে রাখা। সরকারের সমালোচনা করা। ছায়া-সরকারের ভূমিকা পালন করা। শক্তিশালী বিরোধী দল গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়। বিরোধী দল দুর্বল হলে জনগণের কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে। ক্ষমতার স্বভাবই হচ্ছে পাওয়ার করাপ্টস অ্যান্ড অ্যাবসলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি।

গণতন্ত্রের আসল কথা হলো ব্যক্তি-মানুষ। ব্যক্তি-মানুষকে অবমান করে, তার অধিকার ক্ষুণ্ন করে কিছু করা যাবে না, তাকে সুরক্ষা দিতে হবে। বিশাল ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বিপরীতে একজন ব্যক্তি-মানুষ অসহায় যেন বোধ না করে। সে জন্যই গণতন্ত্র, সে জন্যই মানবাধিকার, সে জন্যই আইনের শাসন, সে জন্যই এত কিছু। কিন্তু ক্ষমতার লড়াইয়ে আর উন্মাদনায় সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয় ব্যক্তি–মানুষই। বিরোধী দল সেই জায়গায় ভূমিকা পালন করবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। একই কথা প্রযোজ্য স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়েও।

বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘদিন একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-২০০১–এর ৫ বছরের পর এখন একনাগাড়ে প্রায় ১০ বছর। ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর একবার ‘এ’ দল, একবার ‘বি’ দল নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসছিল, এই রকমই আমরা দেখে আসছিলাম। ২০০৬-এর পর এর ব্যত্যয় ঘটল। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেছে এক ভয়াবহ ঘটনা। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা।

ফুটবল মাঠে দুটি দল থাকে। উভয় পক্ষই গোল করে জয়লাভ করতে চায়। ফাউলও যে হয় না, তা নয়। কিন্তু খেলোয়াড়েরা খেলা ছেড়ে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে আক্রমণ করে বসে না। ২১ আগস্টে তখনকার বিরোধী দলের নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশেয গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। কতজন আহত, নিহত হয়েছেন। এবং এর সঙ্গে তখনকার সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন। সেই মামলার রায় হয়েছে।

এই মুহূর্তে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে। তাঁর সাজা হয়েছে। তারেক রহমান দেশের বাইরে, বলা হচ্ছে পলাতক এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামি। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।

তাহলে কি দেশে বিরোধী দল থাকবে না? ২১ আগস্ট এই দেশে কেবল রক্তপাত ঘটায়নি, বহু মানুষকে নিহত-আহত-পঙ্গু করেনি, দেশের গণতন্ত্রকেও পঙ্গু করেছে। কারণ, এর পরে বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া, পরামর্শ দেওয়াটাকেও বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে, দেওয়া উচিতও; কিন্তু শেখ হাসিনা তা যদি না শোনেন, কোনো কিছু বলার তো থাকে না। তিনি তো বলতেই পারেন, যারা আমার মাথার ওপরে গ্রেনেড ছুড়তে পারে, তাদের সঙ্গে কি সমঝোতা? কিসের আলোচনা?

সেই জায়গাতেই ড. কামাল হোসেন এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের আলোচনার সূত্রপাত আশার সৃষ্টি করে।

পলিটিকস ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। এই কম্প্রোমাইজ মানে আপস নয়। এর মানে সমঝোতা, মীমাংসা। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু একটা শেষ কথা থাকা উচিত। আমরা জানি, শেষ কথা বলে যা চর্চা করা হয়, তা হলো ক্ষমতা। রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতা দখল করতে বা ধরে রাখতে চাইবেনই। কিন্তু শেষ কথা হওয়া উচিত দেশ। শেষ কথা হওয়া উচিত মানুষ। শেষ কথা হওয়া উচিত ব্যক্তি–মানুষের অধিকার এবং তার যোগফল হিসেবে সম্মিলিত মানুষের উন্নয়ন।

জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেই এই মতবাদ বা তার অনুসারীরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। শেখ হাসিনা বলেছেন, হেফাজত আর জামায়াত এক নয়। এটা আমরাও জানি। এই উপাদানগুলো আমাদের রাজনীতিতে আছে, এটা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। তারপরও সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও দ্বিদলীয় রাজনীতিই প্রধান ধারা, এত দিন ছিল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই ধারা। এখন না হয় আমরা বলব, আওয়ামী লীগ এবং না-আওয়ামী লীগ। এই না-আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যদি ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা তাঁদের মতো প্রগতিশীল শিক্ষিতজনেরা আসেন, তাহলে সেটা একটা সুলক্ষণ। গতকালের সংলাপে কোনো সমাধান আসবে, এটা কেউ আশা করেননি। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতটা পেরিয়ে গেছে। এই লেখা তারও আগের।

কিন্তু সংলাপ আসল কথা নয়। শেষ কথাও নয়। আসল কথা হলো, ২১ আগস্টের কুশীলবমুক্ত, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতাই যাঁদের প্রধান অস্ত্র, এই ধরনের রাজনীতিকমুক্ত নেতারা যদি আওয়ামী লীগের বাইরে প্রধান ধারা হয়ে উঠতে পারেন, তার সুফল বাংলাদেশ পাবে। সুফল এই মুহূর্তে আসবে না। কিন্তু তা সুফলই বয়ে আনবে।

ড. কামাল হোসেন শেখ হাসিনাকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা।

যে সকল মহান আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে উজ্জীবিত ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল—তার অন্যতম হচ্ছে “গণতন্ত্র”। গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জনগণের পক্ষে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে এবং জনগণকে শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে—রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনা করবে—এটাই আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার।’

ড. কামাল হোসেন আরও লিখেছেন, ‘ইতিবাচক রাজনীতি একটা জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করে জনগণের ন্যায়সংগত অধিকারসমূহ আদায়ের মূল শক্তিতে পরিণত করে—তা বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন। নেতিবাচক রুগ্ণ-রাজনীতি কীভাবে আমাদের জাতিকে বিভক্ত ও মহাসংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তা–ও আমাদের অজানা নয়। এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানো আজ আমাদের জাতীয় চ্যালেঞ্জ।’

ড. কামাল গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত বলেছেন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনকে। নিশ্চয়ই নির্বাচনই গণতন্ত্রের সবচেয়ে প্রাথমিক শর্ত। তবে সেটাই একমাত্র নয়। সেটাই শেষ নয়। গণতন্ত্রের একটা লিটমাস পরীক্ষা হলো, একজন মানুষও যদি বিরোধিতা করে, সেই একা ভিন্নমতের মানুষটির সঙ্গে রাষ্ট্র কী ব্যবহারটা করছে!

ফলে সামনের নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে যে শঙ্কা, যে অনিশ্চিতিবোধ আছে তা সত্ত্বেও বলব, এই মুহূর্তের ভালো ঘটনা হলো, বিরোধী দলের প্রধান ধারা হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অভ্যুদয় এবং সক্রিয়তা।

আমরা তো আশা হারাব না বলে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার পতাকা বহনকারী দুটি ধারা যদি এই দেশের রাজনীতিতে কায়েম থাকে, তাহলে কি বহু সমস্যার সমাধান আপনা–আপনিই হয়ে যাবে না?

এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে কিন্তু গণতন্ত্রও। কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে গণতন্ত্রই।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক