যে শোকগাথা শক্তির উৎস

জন্মদাতাকে হারানোর বেদনা কতটা মর্মস্পর্শী, কতটা যন্ত্রণার, তা কেবল সন্তানমাত্রই অনুভব করতে পারে। আমার বাবা শহীদ এম মনসুর আলীকে হারানো আমার কাছে এতটা কষ্টের, এতটা শোকের যে তা নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার কলম থেমে যায়। কী করে লিখি বাবাকে হারানোর সেই দুঃখের স্মৃতি! বাবার এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড কি কোনো সন্তান লিখতে পারে? তবু আজ নিজ হাতেই লিখছি বাবার বিয়োগান্ত ইতিহাস।

৩ নভেম্বর এলেই বুকটা ভারী হয়ে যায়। নিজেকে পাথরসম যন্ত্রণাকাতর মনে হয়, চারদিকটা কেমন যেন অসহায় লাগে। কারণ, পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ভোররাতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গে আমার বাবা এম মনসুর আলীকে হারিয়েছিলাম। সেদিন কারা অভ্যন্তরে যেভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে, এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সেই পৈশাচিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।

বাবার সঙ্গে শেষ মুহূর্ত কাটানোর দুঃসহ স্মৃতি দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। আমার বাবা তখন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি বাসভবনে আমরা সপরিবার বাস করতাম। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার দুঃসংবাদটি যখন আমার বাবা পেয়েছিলেন, তখন তিনি কিছু সময়ের জন্য বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। আমি, মা, ভাই-বোন সবাই ভেঙে পড়েছিলাম। বাক্রুদ্ধ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হতেই দেখলাম, বাবা শিশুর মতো অঝোরে কাঁদছেন। তারপর তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টেলিফোনে প্রতিরোধের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কাপুরুষের দল কেউ এগিয়ে আসেনি। এম মনসুর আলী সহকর্মীদের পরামর্শে আত্মগোপনে চলে গেলেন। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও দেখেছি—কী উদ্বেগ এবং প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন, অন্যদিকে প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে দলীয় সহকর্মী, তদানীন্তন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু সহকর্মীর ভীরুতা, আপসকামিতা এবং তৎকালীন সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের কাপুরুষতার কারণে মনসুর আলী সফল হতে পারেননি।

আমি তখন বাকশালের পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই হত্যা করা হতো। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই আমার বাবা মনসুর আলী আমাকে আত্মগোপনে থাকার নির্দেশ দিলেন। মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির এক পরিচিতজনের বাসায় ১৬ আগস্ট গভীর রাতে তিনি আমাকে বিদায় জানালেন। বিদায়বেলায় তিনি বলেছিলেন, দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তা থেকে যেন কখনো বিচ্যুত না হই। বাবার সেই উপদেশ আজও মেনে চলি। বিদায়বেলায় তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন। সেদিন দেশ ছাড়ার মুহূর্তটি পাথরচাপা কষ্টের মতো আজও বয়ে চলেছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন আমার বাবাকে সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন। কিন্তু পরদিনই অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। পরবর্তী সময়ে ৩ নভেম্বর ভোররাতে জেলখানায় নির্মমভাবে বাবাসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো। আমার জীবনের সেই ভয়ংকর দুঃসংবাদটি আমি শুনতে পেলাম ৪ নভেম্বর। আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু বাবাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ থেকেও আমি বঞ্চিত হলাম। বাবাকে হারানোর সেই ক্ষত আজও বয়ে চলেছি।

আমার বাবা শহীদ এম মনসুর আলী বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের ১৪টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই দায়িত্ব পালনকালে তিনি অসহায়-দরিদ্র মানুষকে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তা মানুষ আজও ভুলে যায়নি। বাবার শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমি দেশ ও জাতির কল্যাণে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের মানুষ আমাকে বারবার সাংসদ নির্বাচিত করেছেন। আমার সন্তান প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়ও ওই এলাকা থেকে একবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছে।

সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত এ জন্য যে শহীদ এম মনসুর আলী আমার বাবা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে চারজন জাতীয় নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শহীদ মনসুর আলী অন্যতম। তিনি সর্বমুহূর্তে আমার আদর্শিক নেতা। যখনই আমি কোনো কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তা–চেতনায় সব সময় আমার বাবার জন্য আবেগ অনুভব করি। তিনি যেমন জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছেন। আমার বাবা তাঁর পরিবারের বাইরে প্রতিটি মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবতেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেন তাঁর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। মাঝেমধ্যে মনে হতো আমাদের চেয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালোবাসতেন। সন্তান হিসেবে দেখেছি, ছয় দফার আন্দোলনে যখন অনেক সহকর্মী বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগ করে চলে গেছেন, কারাবন্দী অবস্থা থেকেও আমার বাবা শত প্রলোভন ও চাপের মুখেও তখনকার পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান, সালাম খানদের সঙ্গে যোগদান করেননি।

দীর্ঘ কারাজীবন ভোগ করেছেন, কিন্তু নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেননি। আমার বাবার দৃঢ় অভিব্যক্তি ও মনোভাব দেখেছি ১৯৬৬-৬৭ সালে যখন তিনি পাবনা কারাগারে বন্দী ছিলেন, আমিও বাবার সঙ্গে একই কারাগারে বন্দী ছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম শেষে যখন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, তখন আমার বাবাসহ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দেন। দুঃসাহসিক ও গৌরবময় সেই মুহূর্তগুলো আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সেই দিনগুলোতে কী দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনতে এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে অন্য জাতীয় তিন নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন, তা আমি দেখেছি। খোন্দকার মোশতাকের মতো কয়েকজন সুযোগসন্ধানী ওই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের এই চারজন নেতার মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করার নানা প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আমার বাবা সেই কয় মাস মুজিবনগরের রণাঙ্গনে ছুটে বেড়িয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে হাজারো মানুষকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমি প্রত্যক্ষ করেছি, হাজারো অমানিশার মধ্যেও সাধারণ বাঙালির চেয়ে দীর্ঘদেহী আমার বাবার উজ্জ্বল প্রত্যয়দীপ্ত মুখচ্ছবি। সহকর্মীদের উদ্দেশে তিনি সর্বদা বলতেন, বাঙালির বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশা আল্লাহ মুক্ত করব। জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব সংঘটিত হয়েছিল, তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর আমার বাবা মনসুর আলীকে খোন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এম মনসুর আলী বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। জীবন দেব, তবুও তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে হাত মেলাব না।’ ৩ নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে জীবন দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করেননি।
চারদিকে লক্ষ করি—লোভের কাছে, ভয়ের কাছে অনেক রাজনীতিবিদের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের ছবি। নীতিহীন আদর্শচ্যুত ব্যক্তিদের ঘন ঘন দল বদল, চেহারা বদল, ক্ষমতার জন্য নগ্ন প্রতিযোগিতা। এদের জন্য করুণা হয়। এদের বিপরীতে মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় চার নেতা সাহস, ত্যাগ এবং নেতার প্রতি যে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস দেখিয়েছেন, তা একটি বিরল ঘটনা। তাঁরা জীবন দিয়েছেন কিন্তু নেতার রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেননি। বিশ্বের কাছে দেশবাসীকে ছোট করেননি। জাতিকে কলঙ্কিত করেননি।
আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার করে আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করেছেন।
আমার শহীদ বাবা এম মনসুর আলীর আদর্শ বুকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমৃত্যু কাজ করে যাব। ৩ নভেম্বর মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ বাবার প্রতি এটাই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মোহাম্মদ নাসিম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য