জনগণের আস্থাই সংবাদপত্রের শক্তি

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির সময় ইতিহাসের একটি সম্ভাবনাপূর্ণ কাল অতিক্রম করেছি আমরা। নব্বইয়ের সেই ক্রান্তিকালে আশঙ্কা ছাপিয়ে আশার আলোই বেশি দেখেছিল দেশবাসী। কেননা এরশাদ যে গণতন্ত্র দিয়েছিলেন, তাকে একনায়কতন্ত্র আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে আমরা চেয়েছিলাম আম জনগণের অংশীদারত্ব ও অধিকার নিশ্চিত করে এমন গণতন্ত্র। তবে এতে আমাদের বিক্ষোভের তীব্রতা বোঝা গেলেও এই আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ সম্পূর্ণ বোঝা যায়নি। এই অস্পষ্টতাগুলো বোঝাপড়া করে নেওয়ার মতো সময়ও আমরা পাইনি। রাষ্ট্রে যেহেতু শূন্যতা চলে না, তাই গণতন্ত্রের ধারণাগুলো অস্পষ্ট রেখেই দ্রুত আমরা সংসদ নির্বাচনে নেমে পড়েছিলাম। এতে একধরনের গণতন্ত্র চালু হলো নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাতে আমাদের প্রত্যাশার গণতন্ত্র হলো কি না, সে সম্পর্কে আশঙ্কা ষোলো আনাই থেকে গিয়েছিল।

আজ মনে হচ্ছে বাহাত্তরের সংবিধানের মতো তিন জোটের ১৭ নভেম্বরের (নব্বই সালের) রূপরেখাটিও জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গণ্য করে জবাবদিহিমূলক সার্বভৌম সংসদ তথা সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার শর্তগুলো নিশ্চিত করে নেওয়া দরকার ছিল। সরকার ও সংসদের জবাবদিহির প্রশ্নের সঙ্গে মানুষের বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকার কথা এসে পড়ে। সরকার ও সংসদের ওপর জবাবদিহির চাপ ও তাগিদ সৃষ্টি করতে সক্ষম সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম, তারা এ সম্পর্কে জনগণকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত দেয়, এমনকি তাদের এ কাজে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করে থাকে। গণমাধ্যমের এই স্বাধীন কিন্তু দায়িত্বশীল ভূমিকা ব্যতীত গণতন্ত্র গণতন্ত্র থাকে না, সহজেই তা কোনো ধরনের অভিজাততন্ত্র বা মুষ্টিমেয় মানুষের কর্তৃত্ববাদী শাসন বা শোষণের নামান্তরে পর্যবসিত হয়। এর মধ্যে বড় দুই দলের ভেতর ক্ষমতার রদবদল ঘটেছে নির্বাচনের মাধ্যমে, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানও দেখেছে দেশ এবং এর অজুহাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই কর্তৃত্ববাদী শাসনের দেখাও মিলছে।

সব দেশে সব কালে গণতন্ত্র এক রকম হবে না, হয় না—সেটাই হয়তো বাস্তবতা। সামাজিক সূচক ও অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি, পাশাপাশি জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ মোকাবিলায় কিংবা বঙ্গবন্ধু হত্যা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ ইতিহাসের দায় মেটানোয় ভালো অগ্রগতি হলেও গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই সময়ে আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি—বাংলাদেশে কোন ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা আমরা করতে চেয়েছি?

এ বিষয়ে গণপরিসরে কোনো আলোচনা ও বিতর্ক হয়নি। দুই বড় দল আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতেই আলোচনায় বসার মতো অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে হাতের মুঠোয় এনে বা রেখে ক্ষমতা নিশ্চিত করাই যেন গণতন্ত্রচর্চার শেষ কথা। তাতে সরকার ও জনগণের ইতিবাচক অর্জনগুলোর ভিত্তি দৃঢ় হচ্ছে না। অথচ তা–ও যথাযথভাবে আলোচিত হচ্ছে না।

নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, দুর্ভিক্ষ ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সরকার স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হলে এবং গণমাধ্যম স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকলে যেকোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাই আগাম জানতে পারে ও সময়মতো সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে। জনগণের যেকোনো পর্যায়ের দুর্ভোগ কমাতে হলে স্বাধীন গণমাধ্যমসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রয়োজনীয়। সেদিক থেকে বলা যায়, জনগণ যে আর্থসামাজিক সচ্ছলতা ও নিরাপত্তা কামনা করে, তার সঙ্গে গণতন্ত্র ও স্বাধীন গণমাধ্যমের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ এবং গভীর।

যে স্বৈরাচারী এরশাদ আমলকে প্রত্যাখ্যান করে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ও গণতন্ত্রে উত্তরণ, তারপরও সেই একই ধারার শোষণ, লুটপাট ও দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে বিশ্লেষকের হতভম্ব হয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বর্তমান সরকারের আমলে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, সামাজিক সূচকে অগ্রগতি চমকপ্রদ, যোগাযোগ ও অবকাঠামোর উন্নয়নও তাৎপর্যপূর্ণ; কিন্তু তা সত্ত্বেও লুটপাট, শোষণ, দুর্নীতির অপ্রতিহত অগ্রযাত্রা এবং সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রাছাড়া গতি দেখে মানুষ অসহায় বোধ করলে দোষ দেওয়া যাবে না।

আমাদের সংবাদপত্র ঐতিহ্যগতভাবে ছিল জনগণের পক্ষের শক্তি, প্রতিবাদী এবং সাহসী। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সেভাবে বিকশিত না হওয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কোনো শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়নি। শক্তিধর বেআইনি বিত্তের বেপরোয়া ক্ষমতাধর শ্রেণির পক্ষে জনগণের সামনে নিজেদের কার্যক্রম সবটা তুলে ধরা সম্ভব নয়। কারণ এর খোলসটা তুলে নিলে দেখা যাবে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও হিংসার হলাহল আর বিকার, যা যেকোনো ব্যবস্থা ও আইনের প্রতি হুমকিস্বরূপ। তাই দেখি যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, সরকার নিজে থেকে জবাবদিহি করতে চায় না। অন্যদিকে যে দলই বিরোধী অবস্থানে থাকুক, তাদের লক্ষ্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা বা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়, কেবল সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও ক্ষমতা ফিরে পাওয়া চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। উভয়ের এ আচরণের যোগফল হলো গণতন্ত্রে জবাবদিহি আদায়ের যেটুকু ব্যবস্থা থাকে, তা ক্রমে অকার্যকর হওয়া। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবক্ষয়ের সুযোগে চরমপন্থা, জঙ্গি আদর্শবাদ, ধর্মান্ধতা মাথা চাড়া দেওয়া সহজ হয়, যা বাংলাদেশে ঘটেছে। ফলে বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও সামাজিক সূচকে ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।

সরকার নানা ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর চাপের মধ্যে পড়লেও স্বাধীন গণমাধ্যমের নিরীক্ষণের সম্মুখীন হতে সহজে চাইছে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মাত্রা ও সীমা বরাবর সরকারই বেঁধে দিতে চেয়েছে। অবাধ্যতা দেখালে, অর্থাৎ স্বাধীন, নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করলে ‘উপযুক্ত’ শাস্তি দিতে কসুর করে না। বর্তমানে অনেকগুলো বেসরকারি রেডিও–টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে, রেডিওগুলো সম্পূর্ণই শৌখিন এবং সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে তাদের কোনো স্বাধীন অবস্থা বোঝা যায় না। টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটির সংবাদ পরিবেশনা বেশ ভালো, ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রচারিত হচ্ছে। তবে দুর্নীতিসহ রাজনৈতিক ইস্যুতে সরকারের অনুসৃত নীতির বাইরে সচরাচর পা বাড়ায় না কেউ। এ রকম একটি ক্ষেত্রেও সরকার কঠোর মনোভাব দেখাতে দেরি করেনি। এ অবস্থায় রেডিও–টেলিভিশন গণমাধ্যম হিসেবে সংকটকালে জনগণের সম্পূর্ণ আস্থাভাজন হতে পারেনি।

কিন্তু এর মধ্যেও সংবাদপত্র, আমরা সানন্দে লক্ষ করছি, বিপন্ন ভুক্তভোগী ন্যায়প্রত্যাশী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ ও আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো উত্তরোত্তর হস্তক্ষেপের পরিধি বাড়িয়ে নেওয়ায় এবং বিভিন্ন সময়ে আইনজীবীদের মধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের প্রতি অনাস্থার বিক্ষুব্ধ বহিঃপ্রকাশ বোঝা যায়, উচ্চ আদালতও মানুষের আস্থা রক্ষা করতে বেগ পাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে বরং সংবাদপত্র অনেকটা সাহসী ও সৎ ভূমিকা পালন করছে।

এখানে যেহেতু জনগণের অজান্তে অনেক কিছু ঘটে যায়, তাই আদালতের চেয়েও ক্রমপ্রসারমাণ অনলাইন ও প্রথাগত গণমাধ্যমের সহায়তায় গোপন বিষয়টি ফাঁস করে দিয়ে অপরাধকে আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগত বেদনাকে সর্বসাধারণের গোচরে আনতে চায় ভুক্তভোগী মানুষ। এতে তার মনে যেমন লড়ার সাহস সঞ্চারিত হয়, তেমনি ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরাও একটু সমঝে চলতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম তাই বর্তমান সময়সহ সব সময়েই উত্তরোত্তর চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আপাতত এখান থেকে পিছু হটারও উপায় নেই। কারণ সরকার, তা সে যে দলেরই হোক আর যতই গণতান্ত্রিক হোক, আরও বেশ কিছুকাল কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ শক্তভাবে ধরে রাখতে চাইবে। সরকার গঠনে সক্ষম প্রধান দুই দলের পরস্পরের প্রতি অন্ধবিদ্বেষ ক্ষমতাকে অন্ধ করেই রাখবে। সার্বিক ক্ষমতা ভোগের কারণে দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের প্রতি উপেক্ষা দেখাবে আর বিরুদ্ধপক্ষের প্রতি বৈরিতায় সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে আন্তরিক থাকবে। একদিকে সরকারের এই অনড় অবস্থান আর অন্যদিকে জনগণের ক্রমবর্ধমান দাবির মাঝখানে পড়ে গণমাধ্যমের জন্য পিছু হটার উপায় থাকছে না। বিবেকি গণমাধ্যমকে জেনেশুনে শাঁখের করাতেই ঢুকতে হচ্ছে। তবে জনগণ এ ধরনের গণমাধ্যমের পাশে থাকছে। তারা বিশেষভাবে সংবাদপত্রের শক্তি সম্পর্কে অবগত আছে, আর তাদের আস্থা পেয়ে কোনো কোনো সংবাদপত্র সাহসী ভূমিকা নিতে সক্ষম হচ্ছে।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক