রোহিঙ্গা গণহত্যায় হাওয়া দিয়েছে ফেসবুক?

গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটির মূল বিষয় হচ্ছে ফেসবুকজুড়ে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী প্রচারণা। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসঞ্চারী কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছে ওই প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী একজন মন্তব্য করেছেন, মুসলমানরা বৌদ্ধদের জন্য হুমকি। আরেকজন লিখেছেন, রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ নারীদের ধর্ষণ করেছিল। অবশ্য এসব মন্তব্যকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও দমনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ফেসবুক ও টুইটারে এসব বানোয়াট প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। শুধু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বা সরকার-সমর্থকেরাই নন, অন্য দেশের লোকজনও রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিদ্বেষমূলক ও ঘৃণাসঞ্চারী পোস্ট দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সিনেমা পর্যন্ত বানিয়েছেন। মনে হচ্ছে, সবাই একযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের তুলনা চলে। এই দুই জাতিই নিজভূমে পরবাসী। অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অপপ্রচারের শিকার। অথচ এদের পক্ষে কথা বলার দেশ কম; বরং আছে তাদের বিরুদ্ধে নানামুখী প্রচারণা।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই বিভিন্ন ফোরামে, বিশেষ করে ফেসবুক ও টুইটারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর কথা উঠেছে। প্রথম দিকে ফেসবুক বা টুইটার বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি গা করেনি। পরে অবশ্য চাপের মুখে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ মার্কিন সিনেটরদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারণা পর্যালোচনার জন্য মিয়ানমারের ভাষা জানা লোকদের ভাড়া করা হচ্ছে। এর আগেই অবশ্য মার্চ মাসে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছিল, ফেসবুকের প্রচারণা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যায় উসকানি দিয়েছে। গণহত্যার মুখে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে চলে যায়। জাতিগত নিধনের মুখে পড়ে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন আরও বলা হয়েছে, সামাজিক যোগযোগমাধ্যম গণহত্যায় ভূমিকা রেখেছে। কী ভয়ংকর বিষয়! ফেসবুক বা টুইটার যেখানে হতে পারত গণহত্যাবিরোধী মাধ্যম। প্রতিরোধের উপায়। সেখানে অভিযোগ উঠেছে, এরা গণহত্যাকে উসকে দিচ্ছে। বিদ্বেষ ও ঘৃণাসঞ্চারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

আমেরিকার এথনোমিউজিকোলজিস্ট রিক হাইজমানের টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ এই কারণে। বন্ধের কারণ হিসেবে টুইটার কর্তৃপক্ষ বলেছে, টুইটারের নিয়ম ভঙ্গ করেছেন হাইজমান। ঘটনা হচ্ছে, হাইজমান সম্প্রতি একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে এই সিনেমাকে মুসলিমবিরোধী ও বিদ্বেষমূলক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই সিনেমায় হাইজমান উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রোহিঙ্গাদের কটাক্ষ করেছেন। ঘৃণা ছড়িয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, একটি জাতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়ানো হলো, বর্ণবাদী প্রচারণা করা হলো। কিন্তু কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারল না! ফেসবুক নাকি এখনো বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করছে। বর্ণবাদী আচরণের কয়েকটি নমুনা দেখা যাক। ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী পোস্টে বলা হয়েছে, হিটলার যেভাবে ইহুদিদের হত্যা করেছে, একইভাবে রোহিঙ্গাদের শায়েস্তা করা হবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এক প্রকাশনায় পুলিশ ফাঁড়িতে রোহিঙ্গাদের আক্রমণের অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, ‘বাঙালি কুকুরেরা আমাদের দেশ ধ্বংস করছে। আমাদের জাতি ধ্বংস করছে। রোহিঙ্গাদের সমূলে মিশিয়ে দিতে হবে।’ যখন রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখনই এসব পোস্ট দেওয়া হয় ফেসবুকে। রোহিঙ্গাভর্তি নৌকার ছবি দিয়ে এক ব্লগে লেখা হয়, নৌকাটি তেল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হোক যেন তারা খুব দ্রুতই আল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে পারে। জাকারবার্গ মার্কিন সিনেটে বক্তব্য দেওয়ার ১১ দিন পর এই ব্লগ ফেসবুকে শেয়ার দেওয়া হয়।

এ রকম আরও অনেক নমুনা পাওয়া যাবে, যা প্রমাণ করে ফেসবুক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন—এমন সাধারণ নাগরিকেরা এটা করেননি। কিছু গোষ্ঠী সুনির্দিষ্টভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে এ কাজ করেছে। ফেসবুক বা টুইটার বিভিন্ন সময় বলছে বটে যে তারা ঘৃনাসঞ্চারকারী প্রচারণা, পোস্ট, ছবি রোধ করতে কাজ করছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে সে রকম কার্যকর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি।

দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুক দাবি করে আসছে, একটি ভালো সমাজ গঠনে সবাইকে একটি জায়গায় নিয়ে আসার জন্য ফেসবুক কাজ করছে। কিন্তু মিয়ানমারে এর বিপরীত ঘটেছে। ফেসবুক সমাজকে বিভাজিত করেছে ও ঘৃণার বিস্তারে পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের অনেক ছবি ও ঘটনার বিবরণ ফেসবুক থেকে মুছে দিয়েছে এই যুক্তি দিয়ে যে এসব ছবি ভুয়া বা বীভৎস। এগুলো সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। হ্যাঁ, এটা সত্য যে ওই হামলা ও ধ্বংসের অনেক ভুয়া ছবি ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। এই ভুয়া ছবি নিয়ে ফেসবুক বা টুইটার যতটা তৎপর, বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রচার বন্ধে ততটা সক্রিয় ফেসবুক ও টুইটারকে দেখা যায়নি।

গণহত্যায় কেউ কেউ সরাসরি অংশ নেয়। আবার কেউ উসকে দেয়। পরোক্ষ সমর্থন দেয়। এর আগে অনেক লেখায় সেব্রেনিতসা গণহত্যার কথা উল্লেখ করেছি। ওই গণহত্যা পরিচালনাকারী সার্ব জেনারেলদের সাজা হয়েছে। কিন্তু এখন এটাও আলোচনা হচ্ছে, যারা সেব্রেনিতসা গণহত্যার পথ করে দিলেন, পেন্টাগনে বসে চুপচাপ গণহত্যার মিশন অবলোকন করলেন, তাঁদের কি বিচার হবে না? তাঁদের বিচার হয়তো হবে না। তবে এরাও কিন্তু হিসাবের বাইরে না। আমেরিকা, ন্যাটো গণহত্যার দোসর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের গণহত্যার দায়ে বিচার হতে পারে। সেদিন গণহত্যার দোসর হিসেবে ফেসবুক, টুইটারের নাম উচ্চারিত হলে, রোহিঙ্গাবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত হলে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

স্মরণ করা যায়, জার্মানি ও রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচারের সময় গণমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে সম্পাদকদেরও বিচার করা হয়েছিল।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন