রাজাপক্ষের ফিরে আসায় যত শঙ্কা

মাহিন্দা রাজাপক্ষে
মাহিন্দা রাজাপক্ষে

গোটা পক প্রণালি অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ব্যবস্থার টেকটোনিক প্লেটে একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। সর্বশেষ শ্রীলঙ্কায় আমরা সেই পরিবর্তন দেখলাম। প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা আচমকা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে তাঁর স্থলে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে বসিয়ে দিয়েছেন এবং এই ক্ষমতা বদলের সর্বজনগ্রাহ্য সাংবিধানিক ব্যাখ্যাও নেই। ফলে এই বিতর্কিত ক্ষমতাবদলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সিরিসেনা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন।

মাত্র চার বছর আগেও শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ রাজাপক্ষেকে ‘সাক্ষাৎ শয়তান’ হিসেবে দেখত। তাঁর শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন সবার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতি ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা এবং আধিপত্যবাদ ছিল সরকারের অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়। সেই জায়গা থেকে যে সিরিসেনা ২০১৫ সালে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়েছিলেন, সেই সিরিসেনাই আবার তাঁকে হৃত সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটা ঠিক যে রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই। স্থায়ী স্বার্থই রাজনীতির চূড়ান্ত কথা। তারপরও সিরিসেনার হাত ধরে রাজাপক্ষের এভাবে ফিরে আসাটা সবার সামনে অনেক দার্শনিক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

গত দফায় ক্ষমতায় থাকার সময় রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে নিজেকে একরকম ঘোষণাই দিয়েছিলেন। তামিল জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক এমনকি অস্তিত্বগতভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সব উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বিরোধী কাউকে পাত্তা না দেওয়ার প্রবণতা তাঁর মধ্যে এতটাই জাঁকিয়ে বসেছিল যে তার জন্য তাঁকে খেসারত দিতে হয়েছিল। সব বিরোধী রাজনীতিক এক হয়ে ২০১৫ সালে তাঁকে ধরাশায়ী করে ফেলেছিলেন।

রনিল বিক্রমাসিংহে তাঁর রাজনৈতিক অংশীদার সিরিসেনাকে নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। সাধারণ শ্রীলঙ্কানরা এই আশায় বুক বেঁধেছিল যে দেশটি এবার সংলাপ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে এগোবে। কর্তৃত্ববাদ অপসৃত হবে। শুরুতে সে রকমভাবেই সব এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ এই দৃশ্য বদল কেন? এটা ভাবার বিষয়।

ভারতের মতো শ্রীলঙ্কায়ও জাত, পাত, লিঙ্গ, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদির কারণে গোটা সমাজ নানা ভাগে বিভক্ত। ভারতীয়দের মতো শ্রীলঙ্কানরাও সব সময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেঁচাতে ভালোবাসে। কিন্তু একের পর এক সরকার বদল হয়, দুর্নীতি কমে না। এর মূল কারণ হলো নিজের সমর্থিত দলের নেতাদের দুর্নীতি এখানকার সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে কম। প্রতিপক্ষের দুর্নীতিকেই অপরাধ মনে হয়।

শ্রীলঙ্কা দীর্ঘদিন ধরে এমন এক সামন্ততান্ত্রিক অমাত্য গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থেকে এসেছে, যারা চিরকালই ক্ষমতার পাদপ্রদীপে থাকতে পছন্দ করে। রাজাপক্ষের দুঃশাসনকে এই গোষ্ঠী শুধু মেনে নেয়নি, বরং রাজাপক্ষের স্বৈরাচারী শাসনের প্রধান সুবিধাভোগী তারা। এই গোষ্ঠীগুলো মাঠপর্যায়ে রাজাপক্ষের বিরোধিতাকারীদের দমন করেছে। এখন রাজাপক্ষের ফিরে আসায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছে সেই সামন্ত শ্রেণি।

রাজাপক্ষের রাজনীতির মূল অস্ত্রই হলো বিভাজন। সিংহলিদের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়ে সংখ্যালঘু তামিলদের কোণঠাসা করার পুরোনো নীতিকে তিনি এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন। দেশটির অভিজাত শ্রেণি এই নীতিকে সহজে গ্রহণ করে। নিবর্তনমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে তারাই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত থাকে। ফলে রাজাপক্ষে এই গোষ্ঠীর পূর্ণ সমর্থন পাবেন বলে ধরে নেওয়া যায়।

আগামী জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত রাজাপক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে তাঁর দল আবার শক্তি সঞ্চয় করে ফেলবে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ বিক্রমাসিংহের দলের নেতা–কর্মীদের তীব্রভাবে কোণঠাসা করা হবে। রাজাপক্ষে স্বাভাবিকভাবেই চাইবেন, বিক্রমাসিংহের দল যাতে নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে না পারে। ইতিমধ্যে সে ধরনের তৎপরতাও তিনি শুরু করে দিয়েছেন। তামিল নাগরিকদের মনে সেই পুরোনো আতঙ্ক আবার ফিরে এসেছে। রাজাপক্ষে নিজেও চাচ্ছেন বিরোধী শিবির আপাতত তাঁকে ভয়ের চোখেই দেখুক। তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে থাকবে কি না, বলা কঠিন। অভিজাত সম্প্রদায়ের বাইরে, সাধারণ ভোটারদের বড় অংশই এখনো বিক্রমাসিংহেকে দেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী বলে মনে করছে। তারা রাজাপক্ষের ক্ষমতায় বসাকে ‘জাতীয় অপমান’ বলে মনে করছে। নির্বাচন পর্যন্ত এই ক্ষোভ রাজাপক্ষের পক্ষে দমন করে রাখা সম্ভব না–ও হতে পারে। আর যদি ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হয় এবং রাজাপক্ষের দল জিতে যায়, তাহলে শ্রীলঙ্কাকে আরও একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। ভারতের অনলাইন পত্রিকা স্ক্রল ডট ইন থেকে নেওয়া

টি এম কৃষ্ণ ভারতের সাংবাদিক ও লেখক