মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্প কী পেলেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে দেশটির ঐতিহ্যবাহী সুসংহত গণতান্ত্রিক পরিবেশ আবারও দৃশ্যমান হলো। ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের হটিয়ে নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তবে উচ্চকক্ষ তথা সিনেটে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ আরও সংহত হয়েছে। সংখ্যালঘু তথা অশ্বেতাঙ্গ, অভিবাসী, সীমান্তের বাসিন্দা, সমকামীরা বরাবরের মতো ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দিয়েছেন। এবার তাঁদের ভোটের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মধ্যকারই উচ্চশিক্ষিত, তরুণ ও নারী ভোটারদের একটা অংশের ভোট। তাই কংগ্রেসে অসংখ্যালঘু প্রতিনিধিও বেড়েছে। ডেমোক্র্যাটরা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচনে আগের চেয়ে অনেক ভালো ফল করেছে। এবারের নির্বাচনে তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা কম করে জনগণের সামনে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছে। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাল দিয়েছেন অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ অনুপ্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ তাঁর ব্যক্তিগত কিছু প্রিয় বিষয় নিয়ে। এই নির্বাচনে ট্রাম্প অনেক খেটেছেন, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য চষে বেড়িয়েছেন।

এই ফলাফলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আবারও বিভক্ত কংগ্রেস পেল। বিভক্ত কংগ্রেস আমেরিকার ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। বারাক ওবামার প্রশাসন তো শেষের দিকে উভয় হাউসেরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী কংগ্রেসের উভয় কক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিল পাস হতে পারে না। এই বিভক্ত কংগ্রেস যখন-তখন ট্রাম্পের কার্যক্রমের ওপর লাগাম টেনে ধরবে, এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। নতুন বিল পাসের জন্য উভয় কক্ষের সম্মতি তিনি আর আগের মতো পাবেন না।

ঝামেলা এখানেই শেষ নয়, বিভক্ত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ খড়্গহস্ত হতে পারে স্বয়ং ট্রাম্পের ওপরই। আমেরিকার অনেকেই বিশ্বাস করেন, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার যথেষ্ট হাত ছিল। নিম্নকক্ষ এ ব্যাপারে সাক্ষী-সাবুদ, তদন্ত, ফাইলপত্র টানাটানি শুরু করে দিতে পারে। যেহেতু বাজেট অনুমোদনে নিম্নকক্ষের অনুমোদন দরকার, তাই সরকারের যেকোনো সংস্থা যথা এফবিআই, সিআইএ এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। কোনো সংস্থা অসহযোগিতা করলে নিম্নকক্ষ তার বাজেটে ছুরি চালাতে পারে, এটা সবাই জানে। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ট্যাক্স ফাইল নিয়ে লুকোছাপা অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না। এবার নিম্নকক্ষ প্রেসিডেন্টের ট্যাক্স ফাইল নিয়ে টান দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যেকোনো বড় ধরনের গলদ পেলে নিম্নকক্ষ ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্টের প্রস্তাব তুলতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসীদের ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার অবাধ সুযোগও থাকছে না। তাঁর প্রশাসন ইচ্ছে করলেই মেক্সিকোর সীমান্তে আর দেয়াল তুলতে পারবে না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের আগে কট্টরপন্থীদের সমর্থন জোরালো করার জন্য অনাগরিক অভিবাসীদের সন্তানদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নীতি বাতিলের দাবির পালে হাওয়া দিয়েছিলেন। তবে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা এটিকে নির্বাচনী বাগাড়ম্বর (ইলেকশন রেটরিক) হিসেবে শুরুতেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তিনি শিগগিরই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নাগরিকত্ব নির্ধারণের এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর কোনো পরিবর্তনের জন্য পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সুপার মেজরিটি তথা দুই–তৃতীয়াংশ (৬৭ শতাংশ) সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় সরকারগুলোর অনুমোদনও প্রয়োজন। বিভক্ত কংগ্রেস ট্রাম্পের আশার গুড়ে যথেষ্ট পরিমাণ বালি ঢেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বেশি ঘাড় বাঁকা করে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করলেও নিম্নকক্ষ হস্তক্ষেপ করতে একমুহূর্ত দেরি করবে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সুপ্রিম কোর্ট তো আছেনই শেষ অস্ত্র হিসেবে।

এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বেফাঁস কথাবার্তা বলার যে বদভ্যাস আছে, এবার তা–ও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলে মনে হয়। তাঁর কোনো বক্তব্য যদি নিম্নকক্ষের কাছে ‘মোর দেন স্পিচ’ বলে মনে হয়, তাহলে নিম্নকক্ষ সেখানেও বাগড়া দিতে পারে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইচ্ছেমতো কথা বলা ও কাজ করার সুযোগ আর অবাধ থাকছে না বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আর তাঁর খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলতে পারবেন না।

স্বাধীনভাবে চিন্তা, ভাব ও মতপ্রকাশের দেশ আমেরিকা। এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা সংবিধান রচনার সময়ই ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন রোধের আইনি বিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করে গেছেন। কোনো এক ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্টও নিজের খেয়ালখুশি বা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিতে পারেন না। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ, আদালত, স্থানীয় সরকারসহ নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হয়। সামগ্রিকভাবে এটা একটা স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, যা আমেরিকার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বহমান রেখেছে। আমেরিকান গণতন্ত্রের আদি পথিকৃৎদের সৃষ্ট ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সেই ব্যবস্থাটি দিনে দিনে আরও মজবুত হয়েছে, যদিও কখনো কখনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সরকারপ্রধানদের লাগামহীন কথাবার্তা ও আচরণে মনে হতে পারে যে সেই ব্যবস্থাটি দুর্বল হয়েছে।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৮–এর মধ্যবর্তী নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে আমেরিকার জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র আরও একবার সুসংহত হলো। তাঁরা বলছেন, এটি কখনো এক পার্টির দেশ নয়, বহু দলের, বহু মতের ও বহু জাতের মানুষের দেশ। যেকোনো একক শক্তির অবারিত ক্ষমতার প্রাধান্য এ দেশের সৌন্দর্যমণ্ডিত বহুমতের চর্চা ও সাংবিধানিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ন করতে পারে। যুগে যুগে, কালে কালে এ দেশের জনগণ সময়মতো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে, ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন সেই ভারসাম্য ও প্রতিসাম্যের পথে আরও একটি লম্বা ও দৃঢ় পদক্ষেপ।

তৌহিদ এলাহী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষারত