অনুসরণীয় হয়ে উঠছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া

গত অক্টোবরে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ ব্রাজিলে জাইর বোলসোনেরো নামের যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি কট্টর ডানপন্থী বলে কুখ্যাত। তিনি বহু আগে থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে অস্ত্র থাকার পক্ষে কথা বলে এসেছেন। প্রতিপক্ষকে নির্যাতন-দমন করার পক্ষে কথা বলে এসেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, নির্বাচন দেশের জন্য কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। একমাত্র গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। প্রয়োজনে ৩০ হাজার লোক মেরে ফেলতে হবে, তাতে যদি কিছু নির্দোষ লোকও মরে, মরুক। সব যুদ্ধেই কিছু নির্দোষ লোক মরে।

বোলসোনেরোর মতো নৃশংস মানসিকতার লোকের পাশাপাশি এই বিশ্বে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, সি চিন পিং, ভ্লাদিমির পুতিন, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ভিক্তর ওরবান ও রদ্রিগো দুতার্তের মতো কর্তৃত্ববাদী কট্টর নেতা। এই নেতারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে এসেছেন বটে, তবে তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের মতো করে। গত জানুয়ারিতে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১৮ সালের গণতন্ত্র সূচকে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গণতন্ত্রের আদলে স্বৈরতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে বেশি। সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিন বলেছে, ‘বিশ্বজুড়ে এক নতুন ধরনের নেতৃত্বের উত্থান ঘটছে। আমরা এখন লৌহমানবদের যুগ পার করছি।’

এসব কথা ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, তুরস্ক ও ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে খাটলেও মালয় দ্বীপপুঞ্জের ক্ষেত্রে তা মোটেও খাটে না।

৬০ বছরের মাথায় মালয়েশিয়ায় গত মে মাসে তুমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। শেষ পর্যন্ত দেশটিতে জবাবদিহি, উন্মুক্ত বাক্‌স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুয়ার খুলে গেছে। পশ্চিমারা যুক্তি দেন, মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা করা কঠিন। কিন্তু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাঁদের সেই ভাষ্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে পেরেছে। এই দুটি দেশই এখন সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ‘রিফরমেসি’ কথাটার সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। ইংরেজি ‘রিফরমেশন’ (সংস্কার) শব্দের প্রতিরূপ এটি। এই দুটি দেশ এখন জোর কদমে রিফরমেসির দিকে এগিয়ে চলেছে। তিন দশক ধরে চলা সুহার্তোর স্বৈরাচারী সরকারের খপ্পর থেকে ১৯৯৮ সালে বেরিয়ে আসার পর ইন্দোনেশিয়ায় এখন একটি প্রাঞ্জল গণতন্ত্রের ধারা বইছে। বহু দেশের তুলনায় এই দেশে এখন মানবাধিকারকর্মী ও সংবাদকর্মীদের কথা বলার অধিকার বেশি। সেখানে নারী আন্দোলন জোরদার হয়েছে, শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকের অধিকার আদায়ে সরকারের সঙ্গে নিঃসংকোচে দেনদরবার করতে পারছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও মানবাধিকার সংরক্ষণে সেখানে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে।

ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়ায় হিযবুত তাহ্‌রিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়া প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো দেশটিতে অন্য তেমন কোনো নিবর্তনমূলক তৎপরতা চালাননি। এনজিও ও সংবাদমাধ্যমকে সরকারের সমালোচনা করতে দেওয়ায় সেখানে বাধা দেওয়ার ঘটনা খুবই কম।

ইন্দোনেশিয়ার প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়াও এখন সংস্কারের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে পুনর্গঠন করছে। গত মে মাসে কর্তৃত্ববাদী নাজিব রাজাকের পতনের পর তাঁর ব্যাপক দুর্নীতির তদন্ত করা হচ্ছে। মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় ‘একনায়ক’ হিসেবে দেশ চালিয়েছেন। সেই মাহাথির গত নির্বাচনে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসেছেন। তাঁর সমালোচনা করায় এক ব্যক্তিকে আটক করার পর মাহাথির টুইট বার্তায় বলেছেন, তাঁর সমালোচনা করায় কাউকে আটক করা যাবে না। অর্থাৎ মাহাথির সেই কর্তৃত্ববাদী চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে উদার নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। গত মাসে মাহাথিরের সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা স্থগিত করেছে। মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা। নারীদের ঋতুস্রাব-সংক্রান্ত পণ্যের ওপরে দেশটিতে যে ‘পিংক ট্যাক্স’ নেওয়া হয়, সেটিও বাতিল করবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে।

অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার সুশীল সমাজ নিয়মিতভাবে সরকারের নেতিবাচক কাজের সমালোচনা করে। প্রয়োজনে আন্দোলনও করে। দেশটির দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা করাপশন এরাডিকেশন কমিশন (কেপিকে) এতটাই জোরালো যে গত এপ্রিলে দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার সত্য নোভান্তোকে তারা দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে এবং তাঁর ১৫ বছরের জেল হয়েছে।

আসিয়ানভুক্ত এই দেশ দুটি এতটাই শান্তিপ্রিয় যে সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুলের অধ্যাপক কিশোর মাহবুবানি মনে করেন, দেশ দুটির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত। গণতন্ত্রের চেতনা বিস্তারে দেশ দুটির কার্যক্রমকে অন্যদের অনুসরণ করা উচিত।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ম্যাক্স ওয়াল্ডেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক গবেষক