'ঝামেলা' তাড়াতে আস্থার সংকট সৃষ্টি

প্রায় সব বিরোধী দলের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ৩৫ দিন আগে ৬টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিজ প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এল। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলে আসছিলেন সব দল না চাইলে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ৬টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন ভোটার, রাজনৈতিক দল কিংবা সমগ্র বাংলাদেশকে কী বার্তা দিতে চায়, তা অস্বচ্ছ এবং অস্পষ্ট। ২৩ নভেম্বর ঢাকার একটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার ‘ঝামেলা’ দূর করতে হবে এবং ইভিএম এ কাজটি করতে পারে (যুগান্তর, অনলাইন সংস্করণ, ২৪ নভেম্বর)। অবশ্য ব্যালট পেপারে ভোট দিলে কী ধরনের ‘ঝামেলা’ তৈরি হয় এবং সেই ‘ঝামেলা’ ইভিএম কীভাবে দূর করতে পারে, তা তিনি বলেননি।

অতীতে বিভিন্ন দেশে কণ্ঠভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হতো। গোপনীয়তা আনার জন্য ব্যালট পেপারের প্রচলন হয়। তবে যিনি ভোট দিচ্ছেন তিনি কিন্তু দেখতে পারেন তিনি কাকে ভোট দিচ্ছেন। ব্যালট পেপারকে ‘ঝামেলা’যুক্ত মনে করলেও ঐতিহাসিকভাবে ব্যালট পেপার স্বচ্ছ। যেমন

আমাদের দেশের একজন সাধারণ ভোটার ভোট বলতে বোঝেন ছয় তলের একটি চারকোনা ব্যালট বাক্স, একটি ব্যালট পেপার এবং একটি সিলকে। একজন ভোটার যখন ব্যালট পেপারে সিল লাগান, তখন তিনি তাঁর নিজের চোখে দেখতে পারেন তিনি কোথায় ভোট দিচ্ছেন। তিনি ব্যালট পেপারটিকে ভাঁজ করে এজেন্টদের উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্সে ফেলেন। ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের অনেক স্বচ্ছতা ইভিএম কেড়ে নেবে। কারণ, ভোটদানের বিষয়টিকে ইভিএম আরও গোপনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে । ইভিএমে একজন ভোটার তাঁর পছন্দমতো বাটন ঠিকই পুশ করবেন কিন্তু ভোটটা আদৌ তাঁর পছন্দের প্রার্থী পেলেন কি না, তা তিনি দেখতে পারবেন না। ইভিএম এই জায়গাটায় বড় অস্বচ্ছ। জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইউয়াকিম ভিসনা এবং তাঁর পুত্র উলরিখ ভিসনা এই অস্বচ্ছতার কারণেই জার্মান সাংবিধানিক আদালতে ইভিএম বাতিলের আবেদন করেন। ২০০৯ সালের ৩ মার্চ আদালত ‘পাবলিক নেচার’ নেই বলে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। সাংবিধানিক আদালতের বিচারক আন্দ্রিয়াস ফসকুলার মতে, ইভিএম অস্বচ্ছ এবং অন্ধভাবে প্রযুক্তিকে বিশ্বাস করা ছাড়া ইভিএম দিয়ে কীভাবে ভোট গ্রহণ ও গণনা করা হয়, তা একজন সাধারণ ভোটারের বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই।

সারা পৃথিবীতেই ইভিএম একটি বিতর্কিত বিষয়। যেসব দেশ পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে ইভিএম চালু করেছিল, তাদের বেশির ভাগই পরবর্তী সময়ে ইভিএম থেকে সরে এসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতেও ইভিএমের বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ কাউন্টিতে ভোটাররা ভোট দেন ব্যালট পেপারে, সে ব্যালট পেপার ইলেকট্রনিক কাউন্টিং মেশিন দিয়ে গণনা করা হয়। এতে একটি সুবিধা হলো, যেহেতু ব্যালট পেপারের অস্তিত্ব আছে, সেহেতু গণনায় ভুল হলে নতুন করে গণনা করা যায়।

আমাদের পদ্ধতিটিকে বলা হয় ডিআরই (ডিরেক্টলি রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক) সিস্টেম, যা পদ্ধতিগতভাবেই কম নিরাপদ। একজন শিক্ষানবিশ প্রোগ্রামার এর জন্য এমনভাবে কোড লিখতে পারবেন, যাতে একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর ডিসপ্লেতে দেখা যাবে এক রকম, মেমোরি মডিউলে লেখা হবে আরেক রকম এবং ফলাফল তৈরি করবে আরেক রকমভাবে। একটি কম্পিউটারের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত সব সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের বছরের পর বছর গবেষণার পরেও কম্পিউটার বাগ, ক্র্যাশ, ভাইরাস, দুরভিসন্ধিমূলক সফটওয়্যার, ডেটা টেম্পারিং থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আমাদের ইভিএম নির্মাতারা এসব থেকে মুক্ত যন্ত্র বানাবেন, সে দাবিতে সন্দেহ থাকবেই। ঝুঁকিটা অনেক বেশি, সে তুলনায় প্রাপ্তিটা হবে অতি নগণ্য। যেহেতু পেপার ট্রেইল নেই, কারচুপির অভিযোগ উঠলে তা প্রমাণ করা কার্যত অসম্ভব। ইভিএম টেম্পারিং করা যাবে না—এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না বলে নেদারল্যান্ডস ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছে।

ইভিএম সার্বিকভাবে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার সময় কমিয়ে আনতে পারবে না, ইভিএম নির্বাচনী ব্যয় বাড়াবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের
সঙ্গে আলোচনা এবং মতবিনিময় সভাগুলোতে নির্বাচন কমিশন যে কথাগুলো বলতে চেয়েছে, তার সারমর্ম হলো ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন সহজতর, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে। ইভিএমের কারণে নির্বাচন সহজতর হতে পারে, তবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ইভিএম দিতে পারে না। যে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সীমাহীন অভাব রয়েছে, সে দেশে এ ধরনের পরিবর্তন সব দল রাজি হলেও করা উচিত নয়। সাধারণভাবে সবাই বিশ্বাস করে, স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে এখনো কোনো নির্বাচনই পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়নি। এ রকম একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার বিশ্বাসহীনতা আরও বাড়াবে, নির্বাচন আরও বেশি অর্থহীন হয়ে পড়বে। যেখানে নির্বাচনে এ দেশের মানুষের একটি আস্থার স্থান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এখন আর নেই, সেখানে নির্বাচন কমিশনের সীমিত পরিসরে হলেও ইভিএম দিয়ে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত অনাস্থা আরও বাড়াবে।

এ বছরের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন তিনি ইভিএমের পক্ষে, তবে তিনি তাড়াহুড়ো করে ইভিএম চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে নন। তিনি সীমিত পরিসরে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম চালু করার কথা বলেন। তিনি জানিয়েছিলেন ইভিএম চালু করা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের একটি অংশ (ডেইলি স্টার, অনলাইন সংস্করণ, ৩ সেপ্টেম্বর)। নির্বাচন কমিশনও সীমিত পরিসরে ৬টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার আইন পড়াই, তাঁদের কাছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনটি একটি চমৎকার এবং অসাধারণ উদ্যোগ বলেই মনে হয়েছে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের নামে গণতন্ত্রের একটি অন্যতম ভিত্তিভোট গ্রহণকে বিতর্কিত ইভিএম দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা সমীচীন হবে না। নিকট অতীতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে এবং এ মুহূর্তে ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনই নির্বাচন কমিশনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, ব্যালট পেপারের ‘ঝামেলা’ দূর করা নয়।

কাজী মাহফুজুল হক সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।