যাঁদের নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ

‘কোন দল কী নিয়ে মাঠে নামবে’ শিরোনামে গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি লেখা লিখেছিলাম। পরিস্থিতি তখন ভিন্ন ছিল। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তখনো কাটেনি। এরপর পানি অনেক গড়িয়েছে এবং বেশ দ্রুতই গড়িয়েছে। যুক্তফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্ট—এসব হয়েছে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয়েছে। এখন আমরা বলতে পারছি যে নব্বইয়ের পরের বাংলাদেশে এই প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, আগামী নির্বাচন খুব কঠিন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এমন একটি নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রার্থী বাছাই। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করেছে। তাতে আওয়ামী লীগের যে কৌশল আমরা বুঝতে পারলাম তা হচ্ছে, পুরোনোদের ওপর ভর করেই দলটি জিততে চায়। খেলাধুলায় সাধারণত কোনো দল যখন ধারাবাহিকভাবে জয় পায়, তখন সেই দলে খুব রদবদল করা হয় না। ‘উইনিং কম্বিনেশন’ যাকে বলে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে সম্ভবত এমন কৌশল ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফলে দলটিকে মনোনয়ন দিতে হয়েছে ১০ বছর ধরে সাংসদ থাকা এমন অনেককে, যাঁদের কাজকর্মে স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন ক্ষুব্ধ। দলের লোকজনও কিছু কিছু জায়গায় তাঁদের অত্যাচার–নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মনোনয়ন পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দখলদারি, নিয়োগ-বাণিজ্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করা, সন্দেহজনকভাবে বিপুল বিত্ত অর্জন, চাঁদাবাজি ও এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ এমনকি খুনোখুনিতে জড়িত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এই নামগুলো জানা। পত্রপত্রিকায় তাঁদের বিরুদ্ধে লেখালেখি হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে নিজ দলের স্থানীয় নেতাদের অভিযোগের শেষ নেই। এসব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময় আর হতাশার বিষয় সম্ভবত নিজ দলের নেতাকে খুনের দায়ে জেলে থাকা টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাংসদ আমানুর রহমানের বাবা ও ইয়াবার মতো মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে অভিযুক্ত কক্সবাজার–৪ আসনের সাংসদ বদির স্ত্রীর মনোনয়ন পাওয়া। বোঝা গেল, আওয়ামী লীগ এমন দুজনকেও উপেক্ষা করার অবস্থায় নেই। দলটি তাঁদের পরিবারের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেনি।

আগের লেখাটিতে লিখেছিলাম, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নব্বইয়ের পর যে নির্বাচনগুলোকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয়, সেগুলোর ফলাফল বিবেচনায় বলা যায়, মিত্রদেরসহ দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থনের হার কম-বেশি ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। সেই হিসাবে এমন ভোটার প্রায় ৮০ ভাগ। এর বাইরের লোকজন, মানে প্রায় ২০ ভাগের মতো ভোটারের বেশি অংশ যেদিকে যায়, সেই দলই ভোটে জেতে। একটি মোটামুটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কোনো দলকে জিততে হলে নিজেদের ৪০ ভাগ ভোট ঠিক রাখার পাশাপাশি এই ২০ ভাগ ভোটারের একটি বড় অংশকে টানতে হয়। প্রশ্ন তুলেছিলাম, সামনে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে এই দল দুটি বা তাদের জোট কী আশ্বাস, কী সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি বা চমক নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে? এবং এই ২০ ভাগ ভোটারকে নিজেদের পক্ষে টানতে চাইবে? এই ভোটারদের বিচার-বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিন। কারণ, এখানে নতুন ভোটার যুক্ত হন, যাঁরা প্রথমবারের মতো ভোট দেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়া আঁচ-অনুমান করা সহজ নয়।

আমরা দেখেছি যে নব্বইয়ের পর কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। এর কারণটি পরিষ্কার। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের কিছু স্বাভাবিক সমস্যা থাকে। ক্ষমতায় থাকলে দলের লোকজন দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও নানা অপকর্মসহ স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে পড়েন। আবার সরকারের কোনো কোনো অবস্থান বা আচরণও জনগণকে ক্ষুব্ধ করে। নির্বাচন তাদের সেই ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। তখন দলের একনিষ্ঠ সমর্থক ছাড়া যে ২০ ভাগের মতো ভোটার আছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ ক্ষমতায় থাকা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। অনেক পরিসংখ্যান ও সূচক অনুযায়ী এই সময়ে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে ভালো করেছে। জিডিপি বেড়েছে, কৃষিতে অগ্রগতি হয়েছে, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে বড় সাফল্য আছে। নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকেও সরকার মনোযোগী হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারের সব কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত জনসমর্থন পাবে, এমন নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অবস্থানও জনগণের সব অংশের সমর্থন পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ের দুটি ইস্যু অন্তত আমরা উল্লেখ করতে পারি। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সরকার যে কায়দায় সামাল দিয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই দেশের তরুণসমাজের একটি বড় অংশকে ক্ষুব্ধ করেছে। অবস্থান বদল করতে পারে—এমন যে ২০ ভাগ ভোটারের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে এই তরুণ বা নতুন অনেক ভোটার রয়েছেন। আগের লেখায় লিখেছিলাম, এমন কিছু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে আবার জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে। এমন অবস্থায় ভাসমান ভোটারদের টানতে হলে বড় ধরনের চমক দিতে হবে।

অনেকের মতোই ধারণা ও আশা করেছিলাম, মনোনয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ চমক দেবে। লিখেছিলাম, ভাবমূর্তির সমস্যা নেই; বরং নানা কারণে ভালো ইমেজ আছে—এমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণতর ও নতুন প্রার্থীর মনোনয়ন যদি দলটি সত্যিই নিশ্চিত করতে পারে, তবে তা হবে অর্থহীন যেকোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি কিছু। এর মধ্য দিয়ে দলটি শুধু পরিবর্তনের বার্তা নয়; বরং তারা যে সত্যিই ভালো কিছু করতে চায়, তার প্রমাণ নির্বাচনের আগেই জনগণের সামনে হাজির করতে পারবে। কিন্তু শঙ্কা ছিল; আওয়ামী লীগের মতো পুরোনো, নেতায় ভরপুর ও টানা দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা দলের পক্ষে এমন কিছু করা আদৌ সম্ভব কি না।

সেই শঙ্কা সত্যি হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নের তালিকা থেকে ভোটাররা পরিবর্তনের কোনো বার্তা পাবেন না। নীতিনির্ধারকেরা দলটিকে জেতানোর জন্য স্পষ্টতই ভরসা করছেন সেই পুরোনোদের ওপর, যাঁরা ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবং গত ১০ বছরে তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পাল্লা দিনে দিনে ভারী হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বার্তাটি পরিষ্কার। সরকারি দল কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তারা দলের ‘উইনিং কম্বিনেশনের’ ওপর ভরসা করতে চাইছে। মনোনয়নের আশায় দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের যেসব তরুণ নেতা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ভোটার আকর্ষণ করতে নানাভাবে কাজ করেছেন, জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের ওপর এবার দলটি আস্থা রাখতে পারেনি। কিন্তু ২০০৮  ও ২০১৪ সালের নির্বাচনী মাঠ আর এবারের নির্বাচনী মাঠের ‘কন্ডিশন’ কি এক? ‘উইনিং কম্বিনেশনের’ যে খেলোয়াড়দের ওপর দলটি ভরসা করতে চাইছে, তাঁদের ফর্ম ঠিক আছে তো?

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
[email protected]