লস্করকে ১০ বছরেও রুখল না পাকিস্তান!

ঠিক ১০ বছর আগে (২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর) ভারতের মুম্বাইয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়েছিল। হামলাকারীরা চার দিন ধরে তাজ হোটেল কবজা করে রেখেছিল। হোটেলের ভেতরে নির্বিচারে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এবং গুলি চালিয়েছিল। জঙ্গিরাসহ ওই হামলায় মোট ১৬০ জন নিহত হয়েছিল। পরবর্তী কালে তদন্তে দেখা গেছে, পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার (এলইটি) দুই নেতা জাকিউর রহমান লাকভি ও হাফিজ সাঈদ এই হামলার মূল পরিকল্পক ছিলেন।

পাকিস্তানের পুলিশ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে লাকভিকে আটক করে। পরে ‘যথোপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায়’ ২০১৫ সালে পাকিস্তানের আদালত তাঁকে জামিনে ছেড়ে দেন। অন্যদিকে হাফিজ সাঈদকে গৃহবন্দী করা হলেও পরে ২০০৯ সালে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন থেকেই তিনি পলাতক। ২০১২ সালে হাফিজকে ধরিয়ে দিতে পারলে ১ কোটি ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল।

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এলইটি বারবার ভোল পাল্টিয়েছে। এলইটির সহযোগী সংগঠন জামায়াত-উদ-দাওয়া, ফালাহ্-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন এবং তেহরিক-ই-আজাদি জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর—এ সবগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন হাফিজ সাঈদ। এ সংগঠনগুলোর নাম বদলে ফেলে নানা চেহারায় এলইটি আগের মতোই পাকিস্তানে সক্রিয় রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, মুম্বাই হামলার ১০ বছর পরেও কেন পাকিস্তান এলইটির তৎপরতা বন্ধ করতে পারছে না বা চাইছে না।

এই প্রশ্নের সঠিক জবাব হলো, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে এলইটির একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ভারতীয় তদন্তকারীরা বলেছেন, এই সম্পর্কের কারণেই পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার এলইটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনীহা দেখায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তদন্ত কর্তৃপক্ষের প্রধান তারিক খোসা ২০১৫ সালে লিখেছিলেন, মুম্বাই হামলার পেছনে যে এলইটি জড়িত তার যথাযথ প্রমাণ তিনি পেশ করেছিলেন। কিন্তু তারপরও আদালত ওই হামলায় জড়িত বলে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেননি। রাজনীতিকেরাও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ বছরের শুরুতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ডন পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মুম্বাই হামলায় এলইটি জড়িত। এরপর পাকিস্তানের একটি আদালত নওয়াজ এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করতে নির্দেশ দেন।

বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও সংগঠনকে সামনে রেখে এলইটি তাদের জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন জাত-উদ-দাওয়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে মিল্লি মুসলিম লিগ নামের একটি রাজনৈতিক দল খুলেছে। বলা হচ্ছে, ইসলামি উগ্রবাদীদের মূল ধারার রাজনীতিতে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর পরিকল্পনামতেই দলটি গঠন করা হয়েছে। নতুন দলটি নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন না পেলেও তারা প্রকাশ্যেই নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালিয়েছে। তাদের প্রার্থীরাও মূলধারার রাজনীতিকদের চেয়ে অনেক জায়গায় ভালো করেছেন। যেমন লাহোরে পিপিপির প্রার্থী যুবায়ের কারদারের বিপরীতে মিল্লি মুসলিম লিগের সমর্থিত প্রার্থী শেখ মোহাম্মাদ ইয়াকুব অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কী কারণে তারা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছে?

এলইটি যেহেতু সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করে, সেহেতু তাদের প্রচার–প্রচারণায় তেমন কোনো বাধা নেই। এই গ্রুপটি মূলত বিভিন্ন সেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে গরিব মানুষের সমর্থন ও সহমর্মিতা অর্জন করে থাকে। বিশেষ করে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর তাদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে সাধারণ পাকিস্তানিরা মুগ্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল বন্যা হয়েছিল। তখন সেখানে ফালাহ-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন ব্যাপকভাবে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেছিল। এই সময় আমি তাদের একজন ত্রাণকর্মীর কাছে এই কাজের মূল লক্ষ্য কী, তা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, সংগঠনে নতুন কর্মী জোগাড়ই তাদের মূল লক্ষ্য। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ও সেনাবাহিনী এলইটির এই তৎপরতার কথা ভালো করেই জানে। তবে ইসলামপন্থী এই আন্দোলনকারীদের তারা দেশের জন্য তাৎক্ষণিক হুমকি মনে করে না। সে কারণেই তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়। ঠিক একই কারণে মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের অনীহা লক্ষ করা যায়।

কিন্তু এসব সংগঠনকে আশকারা দিলে খুব শিগগিরই তারা পেছন থেকে ছুরি মারা শুরু করবে। এর প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। এলইটির অনেক নেতা আইএসে যোগ দিয়েছেন। আর আইএস পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এলইটির কার্যক্রম ছড়াচ্ছে। এটি না রুখতে পারলে পাকিস্তানকে চড়া মূল্য দিতে হবে।

(আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত)

তাহা সিদ্দিকী: ফ্রান্সে নির্বাসিত পাকিস্তানের সাংবাদিক