আজব নির্বাচনী ঐক্য, ভোটার নীরব

তোফায়েল আহমেদ
তোফায়েল আহমেদ

নির্বাচন একটি আজব বিষয়। এখানে অনেক জবর মজার ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জলপান। ইঁদুর-বিড়ালের একসঙ্গে ছুঁচো তাড়া করা। গরুর গাড়ি আর হেলিকপ্টারের গতি প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। নির্বাচন কখনো কখনো রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ কিংবা সমীকরণকে পুরোনো পাটিগণিতের লসাগু-গসাগু থেকে ‘লাভক্ষতি’র অধ্যায়ে নিয়ে যায়। সেই লাভক্ষতির নির্ণায়ক শুধুই আসনপ্রাপ্তি।

বেশি আসন ক্ষমতার বেশি কাছাকাছি নিয়ে যায়। তাই তো আজ দেখি হেফাজতের আমির মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী। এখন তেঁতুলে সবার রুচি ফিরে এসেছে, এনেছে শুকনো জিবে জল। শাপলা চত্বরের জমায়েতে যারা উদারভাবে দানাপানি দান করেছিল আর এখানে প্রবল উৎসাহ ছিল, তারা এখন অধিক শোকে পাথর। এ তো একদিক। অন্যদিকে শ্রেণিশত্রু খতমে এবং সামাজিক বিপ্লবের মশাল জ্বেলে যারা আওয়ামী খতমে জান কবুল বা মুজিবের চামড়ায় ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিল, তাদের মার্কা এখন নৌকা। দাঁড়িপাল্লার জামায়াত, দীর্ঘদিন যারা সৎ মানুষের খোঁজে ছিল, গামছা গলায় স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধুপুত্র কিংবা গণমানুষের জন্য গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের জনমালিকানা প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ গণফোরাম এবং পেশাজীবী পার্লামেন্টের দাবিতে সোচ্চার আ স ম রবের জাসদ, নাগরিক ঐক্যের মান্না—সবার হাতে ধানের শীষ। লাঙ্গলওয়ালা হাসপাতাল থেকে ভালোয় ভালোয় ফিরে অতীতের মতো জোয়াল-বলদ ফেলে নৌকার পালেই বাতাস দেবেন, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। একেই হয়তো বলতে পারেন অবাক জোটসঙ্গী, ভোটসঙ্গী কিন্তু মন পড়ে রয় কোথা? ক্ষমতার টানে অন্যখানে? পিছুটান, অতীতের টানাপোড়েন কিংবা পাপবোধ কম হলে ভবিষ্যৎ ভালো ও মসৃণ হয়। তাই-ই হোক।

বিচিত্র এ দেশ! বিচিত্র এ দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি! কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা থেকে ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবিকে কেন্দ্র করে গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। শাহবাগের ওই চত্বর আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠলেও গণজাগরণ মঞ্চ গগনে মিলিয়ে যায় দিনের তারার মতো। তেমনি স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল নিরাপদ সড়ক চাই নামে কিশোর বিদ্রোহ। তেমনি আরেকটি বিস্ময়কর উত্থান ছিল হেফাজতের শাপলা চত্বরের প্রথম জমায়েত। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে আরও একটি অদলীয় সমাবেশ ছিল ‘বিশ্ব ইজতেমা’। মনে হয় অচিরে এ তাবলিগের ইজতেমাও ইতিহাস হতে চলেছে। তাবলিগের অনুসারীরা সড়ক অবরোধ, মারপিট করবে এটি একসময় ছিল কল্পনাতীত। এখন তা-ও বাস্তব। গতকাল টঙ্গীর তাবলিগ ময়দানে কারবালার মহড়া হয়ে যায়। হায় হোসেন, হায় হাসানের বদলে হায় সাথি, হায় সাথি শোনা গেলে বিস্মিত হতাম না। সবই রাজনীতি, সবই ক্ষমতা।

জাতীয় গণমাধ্যম দেখলে মনে হয়, সারা দেশের আকাশ-বাতাস, পশুপাখি, গাছ-বৃক্ষ—সবাই সবকিছু ভুলে সর্বত্র নির্বাচন নির্বাচন করছে। নৌকা আর ধানের শীষের জিকির ছাড়া কোথাও আর কিছু নেই। কুমিল্লা আর চট্টগ্রামের শহরতলির দুটি নির্বাচনী এলাকা তিন-চার দিন ঘুরে অবাক হলাম। কারণ, মানুষের মধ্যে অন্তত তেমন কিছুই দেখা গেল না। যেহেতু ৮ তারিখের আগে সব নির্বাচনী পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার ইত্যাদি অপসারণ করা হয়েছে। সারা দেশ মোটামুটি পোস্টারবিহীন, আপাত পরিচ্ছন্ন। তবে কেউ যে প্রার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা খুবই নগণ্য।

অনেকের সঙ্গে যেচে আলাপ করতে চাইলাম। তারাই উল্টো কপট বুদ্ধিহীন, বোকা বোকা ভাব করে বলে—আমরা ওসব কি আর জানি? আপনারা শহরের মানুষ, বুদ্ধিজীবী, বলুন, নির্বাচন কি হবে? আমি হঠাৎ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ি। এত জোট, হাজার হাজার মনোনয়নপত্র বিক্রি এবং হাজার মনোনয়নপত্র দাখিল। তারপরও ভোটের মালিকগণ বলে কী? ৯ ডিসেম্বরের পর ২০-২১ দিনে ভোটের জোয়ার কেমন আসে দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

ড. তোফায়েল আহমেদ: অধ্যাপক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
e-mail:[email protected]