দণ্ডিতদের নিয়ে কিছু জ্বলন্ত প্রশ্ন

প্রশ্ন ফুরাল না বরং নতুন করে জন্ম নিল। রিটার্নিং কর্মকর্তারা দৃশ্যত অনেক ক্ষেত্রে সৎমায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলে অভিযুক্ত হতে পারেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তিনটি মনোনয়নপত্রই শুধু বাতিল হয়নি—এই দলটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রার্থী, ২০০৭-০৮ সালে যাঁরা ‘ক্যাঙারু কোর্টে’ (দুই প্রধান দলের সর্বসম্মত পরিভাষা) দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁদের আপিল বিচারাধীন থাকলেও তাঁরা সবাই বাতিলের খাতায় নাম লেখালেন। অথচ ওই একই ক্যাঙারু কোর্টে দণ্ডিত এবং সাজা স্থগিত না থাকা অবস্থায় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও পুরো পাঁচ বছর কাটানোর নজির আছে। নির্বাচনী আইন বলুন আর সংবিধান বলুন, আর কোর্ট-কাছারি বলুন, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো আইনকানুনে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। শুধু হাওয়া বদলেছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলেছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত ২৭ নভেম্বর সংবিধানের যে নবতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটা আমরা ঠিক বুঝে থাকলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মনোনয়নপত্র টিকে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেটা টিকে গেছে। হাইকোর্টে বিএনপির পাঁচ নেতার আবেদন নাকচ হওয়ার দিনটিতে অ্যাটর্নি জেনারেল সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, কারও দণ্ড হলে আপিল বিচারাধীন থাকলেই চলবে না। এমনকি আপিলে মুক্তি পেলেও নিস্তার নেই, কারণ সংবিধান অনুযায়ী তাঁকে মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর তিনি সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে যোগ্য হবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের এই ব্যাখ্যা বিবেচনায় নিলে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদির সংসদ সদস্য পদ ইতিমধ্যে খারিজ হয়ে গেছে। কিংবা বাতিল অবস্থায় আছে। এ বিষয়ে দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গত রোববার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মুক্তিলাভের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত অযোগ্য থাকার যে ব্যাখ্যা অ্যাটর্নি জেনারেল দিয়েছেন, সে অনুযায়ী তাঁরা দুজন সাংসদ হতে এবং সাংসদ থাকতে যোগ্য নন। অবশ্য খুরশীদ আলম খান অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত না হলেও বদির সাংসদ থাকা অবৈধ বলেই তিনি মনে করেন। মায়া ও বদির অবস্থা এক নয়। কারণ, মায়া সম্প্রতি খালাস পেয়েছেন। কিন্তু দণ্ডিত বদির আপিল এখনো চলমান রয়েছে।

হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণের ধারাবাহিকতায় অ্যাটর্নি জেনারেল আমান উল্লাহ আমানসহ বিএনপির পাঁচজন প্রার্থীর অযোগ্যতার সপক্ষে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার আংশিক প্রতিফলন আমরা দেখলাম। ক্ষমতাসীন দলের জন্য একরকম, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য অন্য রকম ঘটেছে। দুই বছর বা এর অধিক দণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এমনকি নিম্ন আদালতের দেওয়া ওই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল বিচারাধীন থাকলেও আপিলকারী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না—মর্মে এক আদেশের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ইত্তেফাক-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৭ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছেন, ১. দণ্ড মাথায় নিয়ে নির্বাচন করার বিষয়টি সংবিধান অনুমোদন করে না। এটা সংবিধানের মূল চেতনারও পরিপন্থী। ২. সাজা স্থগিতের কোনো আইন দেশে নেই। ৩. দণ্ড থেকে খালাস না পেলে নির্বাচন করার সুযোগ নেই।

মনোনয়নপত্র বাতিল নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছু সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে আমরা দেখব, দণ্ড মাথায় নিয়ে কেউ নির্বাচন করবেন, কেউ করবেন না। আবার এটা শতভাগ আওয়ামী লীগের পক্ষে ঘটেছে, তা–ও নয়। মৌলভীবাজারে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ছেলে নাসের রহমানের সাজা স্থগিত করা আছে, তাঁর মনোনয়নপত্র টিকে গেছে। যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের বলেছেন, ২০১০ সালে বিচারিক আদালতের সাজা হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাসপেন্ড হওয়ার পরে তাঁর মামলার সেই আপিল শুনানি হয়নি।

ভোলা-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হাফিজ ইব্রাহিমকে নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। দুদক আইনের দুটি ধারায় তিনি দণ্ডিত হন। গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট হাফিজ ইব্রাহিমকে ১০ বছরের সাজা থেকে খালাস দেন। কিন্তু অন্য একটি ধারায় দেওয়া তিন বছরের জেল বহাল রাখেন। তাঁর জেল খাটার মেয়াদ বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্ট তাঁকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এর বিনিময়ে তাঁকে আর জেল খাটতে হবে না। দুদক কয়েক দিন আগেই নাকি পূর্ণাঙ্গ রায় পেয়েছে, আর তাই তারা ১০ বছরের সাজা থেকে মুক্তিদানের বিরুদ্ধে আপিল করেছে গত রোববার। এরপরও তাঁর মনোনয়ন টিকে গেছে।

মন্ত্রী মায়া, হাফিজ ইব্রাহিম, কুমিল্লার বিএনপির নেতা মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ টুকুসহ ২৭ জন একই সময়ে সম্পদের বিবরণী বিষয়ে তথ্য গোপনের দায়ে দণ্ডিত এবং পরে হাইকোর্টে খালাস পান। কিন্তু আপিল বিভাগ তা বিবেচনায় না নিয়ে সবগুলো মামলা পৃথকভাবে অভিযোগের যথার্থতা বিবেচনায় নিয়ে নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছিলেন। সেই এক যাত্রায় বিবিধ ও বিচিত্র ফল চলছেই। বিএনপির নেতা নাসের রহমান ওই ২৭ জনের মধ্যে না থাকলেও তিনিও একই ধরনের মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। নাসের রহমানের মতো মঞ্জুরুল আহসান মুন্সির মনোনয়নও টিকে গেছে। তিনি খালাস পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুদক কিন্তু লিভ টু আপিল ঠুকেছে ঠিকঠাক।

গত ২৭ নভেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, হাইকোর্টের রায়ের ফলে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো অবকাশ থাকল না। তিনি বলেন, ‘সাজা স্থগিত চেয়ে যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁরা সবাই দণ্ডপ্রাপ্ত। এঁদের কেউ দণ্ড থেকে মুক্তিলাভ করেননি এবং মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত হয়নি। এমতাবস্থায় যদি তাঁদের দণ্ড স্থগিত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হতো, তা হতো আমাদের সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এ কারণে উচ্চ আদালত আমাদের যুক্তি গ্রহণ করে তাঁদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া এ মুহূর্তে খালাস পেলেও আগামী পাঁচ বছর নির্বাচন করতে পারবেন না।’ (ইত্তেফাক, ২৮ নভেম্বর, ২০১৮)
আসলে অ্যাটর্নি জেনারেল একটি বিশেষ পরিবেশের অনুকূলে বিশেষ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। কিন্তু আইন ও সংবিধানের ব্যাখ্যা হাওয়াবদলের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে না।

সিরাজগঞ্জ-২ আসনে ইকবাল মাহমুদ টুকুর আইনজীবী গত রোববার যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর দণ্ডাদেশের কার্যকারিতা ২০০৯ সালে হাইকোর্ট তাঁর আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেছিলেন। এরপর তিনি হাইকোর্টে খালাস পান। দুদক তাঁর বিরুদ্ধে আপিল করলে সেই সাজা বাতিল হয়। একটি সাজার বিরুদ্ধে একটি আপিল হবে। তাই সেই আপিলটি সুরাহা হয়নি। রোববার বাদ পড়া বিএনপির মীর হেলাল, মীর নাছির ও টুকুদের আপিল মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টের দুটো বেঞ্চে তালিকাভুক্ত থাকতে দেখেছি। নাসের রহমান ও মঞ্জুরুল আহসান মুন্সির মনোনয়নপত্র টিকলে এঁদেরটা টিকল না কোন যুক্তিতে?

অবাক হলাম সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের সঙ্গে আলোচনায়। রাজশাহীতে যে কারণে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে বলে আমরা জেনেছি, তা তথ্যভিত্তিক হলে সেটা অমার্জনীয় ভুল। সম্পদের বিবরণী ও জঙ্গিবাদে মদদের দুটি মামলায় তাঁর দুটি সাজাই হাইকোর্টে বাতিল হয়। আপিল বিভাগও তা বহাল রাখেন। এসব তথ্য তিনি হলফনামায় দিয়েছেন। এর সঙ্গে দরকারি কাগজপত্রও দিয়েছেন। ব্যারিস্টার সাহেবের বিরুদ্ধে গাছ চুরির মামলা করেছিল দুদক। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলেই তা অসত্য বিবেচনায় পরিত্যক্ত হয়। কোনো মামলাও হয়নি। এ বিষয়ে তথ্য তিনি প্রকাশ করেন। কিন্তু এর সপক্ষে ফটোকপি দেন। কেন তিনি সার্টিফায়েড কপি দিতে পারেননি, সেই অপরাধে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।

হলফনামার আট তথ্যের বিষয়ে সার্টিফায়েড কপির যে দরকার, সেটা আইনে কোথায় আছে?

সার্বিকভাবে ক্রেডিট কার্ড, ঋণ বা বিলখেলাপি, স্থানীয় সরকারের পদ থেকে পদত্যাগের মতো ইস্যুতে মনোনয়নপত্র বাতিলের যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে একপেশে মনোভাবের একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ইসি এখন কী করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mizanur. khan@prothomalo. com