ভোট 'ভালো হবে', 'ভালো হবে না'

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে অবর্ণনীয় তাণ্ডবলীলা সংঘটিত হয়েছে। তার দগদগে ক্ষত এখনো শুকায়নি। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে ফেলার ভাষাহীন বীভৎসতা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেসব ভাবলে এখনো শরীর শিহরিত হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সেই ঘটনাগুলোরই পুনরাবৃত্তি হয় কি না, সেই ভীতি ছিল। আশঙ্কা ছিল নির্বাচন হবে না। সেই আশঙ্কা অনেকটাই কমেছে। দূর হয়নি। জনমনে যে আশঙ্কা তা অনেক গভীরে। এই আশঙ্কা কোথাও থেকে ধার করা নয়। আমাদের সমাজ থেকেই এই আশঙ্কার বীজ জন্ম নিয়েছে।


সংসদ নির্বাচন এলেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কয়েক দিন আগে রংপুরের পার্ক মোড় এলাকা থেকে শহরের দিকে যাচ্ছিলাম। অটোরিকশায় পরিচিত এক ভদ্রমহিলাও ছিলেন। ভোট নিয়ে কথা উঠতেই তিনি বলছিলেন, ‘আমরা তো সংখ্যালঘু, তাই নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। যা হয় হোক। সময়টা পার হলে বাঁচি।’ নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, আমাদের সমাজে নিগৃহীত হন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। আমরা যে এখনো বর্বর যুগেই বাস করি, এটা তার একটি দৃষ্টান্ত।

রংপুর শ্যামাসুন্দরী নদীর পাশে বসে হেমন্তের হালকা শীতের রোদে চেয়ার টেনে বসে ছিলেন বৃদ্ধ আবদুল হামিদ। তাঁর কাছে জেনে নিচ্ছিলাম ৫০ বছর আগে নদীটি কেমন ছিল। ভোট প্রসঙ্গ নিয়ে কথা উঠতে তিনি বললেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকি ভোট হইলে ভোট ভালো হবে না। দ্যাখেন নাই গত বছরের ভোট। এ বছরও ও রকমই একটা কিছু হইবে।’

ভোট সুষ্ঠু হবে না—সবাই যে এমন ধারণা করেন, তা নয়। কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু হবে। কয়েক দিন আগে একটি চায়ের দোকানে কয়েকজনের তর্ক দেখছিলাম। একজন বলছেন, ভোট সুষ্ঠু হবে না। পাশের জন বলছেন, ‘ভোট এ বছর ভালো হইবে। শেখ হাসিনা যত উন্নয়ন করছে, লোকজন ভোট অন্য কাউকে দেবে না।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো নির্বাচন নিয়ে। তাঁরা সবাই এ বছর প্রথম ভোটার হয়েছেন। ২০১৩ সালের শেষে এবং ২০১৪ সালের শুরুতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা সম্পর্কে খুব ভালো জানেন। গ্রামে তাঁদের বাড়ি। তাঁদের একজন বিপুল রায়। তিনি বলছিলেন, ‘গত সংসদ নির্বাচনের সময় বাবা-মা ওই সময় বাড়ির বাইরে যেতে দেননি। ঘরে বসে পড়ালেখা করেছি।’ তাঁরা তিনজনই মনে করেন ভোট হবে। তবে ভোট সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলছিলেন, তিনি কখনোই ভোট দেননি। তবে তাঁর ছোট ভাই গত বছর একাই নাকি অনেকগুলো ভোট দিয়েছিল। যদিও তার এ বছরেও ভোটার হওয়ার বয়স হয়নি।

বর্তমান জাতীয় নির্বাচন কমিশনের আচরণ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়েও নির্বাচন কমিশন একই ভূমিকায় ছিল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থী তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। তাঁরা সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এখনো সরকারের বড় বড় পদে আসীন। এ বছরও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। সরকারি চাকরি করেন—এমন একজন বলছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন নয়। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন কীভাবে সম্ভব? আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দেখতে চাই। জনগণের রায়ের প্রতিফলন দেখতে চাই।’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ষোলো-সতোরো কোটি মানুষ জিম্মি হয়েছিল। গতবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় কি না, সেই ভীতি ছিল জনমনে। এবারের নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কয়েক ধরনের ধারণা আছে। কেউ মনে করছেন, ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার নিরপেক্ষ ভোট করবে না। কেউ বলছেন, ভোট সুষ্ঠু হবে। আর একশ্রেণির মানুষ বিরক্ত। তাঁরা এসব নিয়ে ভাবতেই চান না। তাঁরা মনে করেন, যাঁরাই ক্ষমতায় যান, শুধু নিজেদেরটা দেখেন, জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধারণা পোষণ করা সংখ্যার মানুষও কম নন। এ রকম একজন বিপ্লব তালুকদার। তিনি বলছিলেন, ‘যারাই ক্ষমতায় আসে, তাদেরই নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার জোরে টিকতে পারি না। যে জেতে জিতুক। গ্রামগঞ্জে ছোট ছোট নেতার সঙ্গেই পারা যায় না।’

রাষ্ট্রের ওপরতলায় চলছে নির্বাচনী আসন ভাগাভাগির নানান খেলা। সেখানে রাজনৈতিক আদর্শ সুদূর পরাহত। ক্ষমতায় যাওয়াই এখন সবার মুখ্য চেষ্টা। অনেকেরই মুখোশ খসে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে আসল চেহারা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাবধানী চোখ রাখছেন সবদিকেই। তাঁর চেষ্টা জনসেবা নয়, তাঁর চেষ্টা নিজেকে মামলা-শাস্তি থেকে দূরে রাখা। তাঁর এই চেষ্টার কোথাও গোপন নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে চায়। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে হেরে গেলে ফল যে ভালো হবে না, এটা তাদের জানা আছে। বিএনপি প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল সবাইকে নিয়ে জোট বেঁধেছে। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আছে বিএনপি। জাতীয় পার্টির নেতারা এখন মনে করেন, তাঁরা যাদের সমর্থন দেবেন, তারাই সরকার গঠন করতে পারবে। সে জন্য তাঁরা অবস্থা দেখে মহাজোট কিংবা ঐক্যফ্রন্টে যেতে পারেন। তাঁদের ওপর কারও কোনো বিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো কখনো ব্যক্তিস্বার্থ সমুন্নত করতে, কখনো দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে একেক মার্কার শরণ নিচ্ছে। আমরা চাই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সংস্কৃতি আসুক। জনমতের প্রতিফলন হোক।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক।
[email protected]